শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

লিঙ্গ পরিবর্তন করে প্রেম ও খুন, রহস্য উদঘাটন করল পিবিআই

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

লিঙ্গ পরিবর্তন করে প্রেম ও খুন, রহস্য উদঘাটন করল পিবিআই

ঠিক সাড়ে তিন বছর আগের ঘটনা। ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়ার সাথে পরিচয় ঘটে সেই এলাকায় বসবাসকারী যুবক রাকিবের। তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে শুরু করেন। কিন্তু রাকিব হাসান শাওন এর সাথে আরও এক তৃতীয় লিঙ্গের প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি বুঝতে পেরে চম্পা হিজড়া রাকিবকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে লাশ বস্তায় ভরে সেই এলাকায় ফেলে দিয়ে গাইবান্ধা এলাকায় আত্মগোপন করে চম্পা। কিন্তু পালিয়ে রক্ষা হয়নি। অবশেষে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ঢাকা জেলার একটি টিম। সেই সাথে হিজড়া চম্পার গুরু দেলুকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

বুধবার (২৫ অক্টোবর) রাতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ এলাকার হিজড়া পল্লীতে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।


বিজ্ঞাপন


বৃহস্পতিবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় পিবিআই সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

তিনি জানান, চম্পা মূলত রাকিবের সাথে অন্য হিজড়ার সম্পর্ক মেনে নিতে না পেরে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। শুধু এখানেই শেষ নয়, রাকিবকে হত্যার পর চম্পা গাইবান্ধার হিজড়া পল্লীতে গিয়ে আত্মগোপন করে। সেখানে নিজের নাম বদলে রাখেন স্বপ্না। 

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন— পিবিআই এর ডিআইজি (পূর্বাঞ্চল) মোর্শেদুল আনোয়ার খান, ডিআইজি (পশ্চিমাঞ্চল) মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সায়েদুর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি মোহা. আব্দুল মালেক এবং ঢাকা জেলা পিপিআইয়ের পুলিশ সুপার কুদরত ই খুদা।

তিনি জানান, এ ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আনোয়ার হোসেন মামলার ঘটনাস্থলসহ আশপাশে যোগাযোগ করেন। পাশের ৫ম তলা বিডিং এর মালিক মো. আক্তার হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, লাশ পাওয়ার পরের দিন তার বাসার নিচতলার ভাড়াটিয়া চম্পা নামের এক তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি তার বাবার অসুস্থতার কথা বলে তার গ্রামের বাড়ি জামতলী নারায়ণপুর, জামালপুর সদরে গেছে। তিনি যোগাযোগ করে জানতে পারেন, সেই ঠিকানায় চম্পা হিজড়া নামের একজনের বাড়ি আছে যার পূর্বের নাম নওশাদ। যার বয়স আনুমানিক ২০ বছর। নওশাদের বাবা ও মা মারা গেছেন এবং তিনি ঢাকায় বসবাস করেন। মাঝে মধ্যে গ্রামে যান। বাবা ও মা না থাকা স্বত্বেও লাশ পাওয়ার পরের দিন পিতার অসুস্থতার কথা বলে নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়া বাসা ত্যাগ করে গ্রামে চলে যাওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তাকে খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে রাকিব হাসান শাওন এর নামে একটি ঠিকানা পান তিনি। তদন্তকারী কর্মকর্তা রাকিবের স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করে তার পিতার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তার পিতার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, তার ছেলে রাকিব ঢাকার আশুলিয়ায় এক হিজড়ার সাথে বসবাস করে। কিন্তু কোথায় থাকে সেই ঠিকানা তিনি বা পরিবারের কেউ জানেন না। রাকিব হাসান শাওনের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত একটি মোবাইল নম্বর এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান এই নম্বরটি তার ছেলে রাকিব হাসান ব্যবহার করে। কিন্তু লাশের ছবি দেখালেও তিনি তার ছেলের লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি ডিএনএ পরীক্ষা করান। ডিএনএ পরীক্ষার এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ঢাকার আশুলিয়ায় পাওয়া অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশই তার সন্তান মো. রাকিব হাসান শাওন। 


বিজ্ঞাপন


যেভাবে নওশাদ থেকে চম্পা হিজড়া হলো

নওশাদ ওরফে চম্পা মূলত জন্মগতভাবে হিজড়া ছিল না। তিনি বিবাহিত পুরুষ এবং নাম ছিল নওশাদ। তার ১২ বছর বয়সী আকাশ নামের একজন পুত্র সন্তান আছে। প্রায় ১১ বছর আগে তার স্ত্রী মারা যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি কর্মবিমুখ হয়ে বেকার জীবন যাপন করতে থাকে এবং হতাশ হয়ে পড়ে। স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তার সাথে দেলু হিজড়ার পরিচয় হয়। দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং বলে হিজড়া হলে সে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারবে। দেলু হিজড়ার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেয়।

এর দেড় বছর পর দেলু হিজড়ার কথামত খুলনার লোহাপাড়ায় একজন ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন করে মেয়ে হিজড়া হয়। ওই ডাক্তার অনেক লোককে অপারেশন করে হিজড়া বানিয়েছে। হিজড়া হওয়ার পরে নওশাদ তার নাম পরিবর্তন করে চম্পা নাম ধারণ করে দেলু হিজড়ার অধীনে ৪/৫ বছর কাজ করে। পরে তিনি ঢাকার আশুলিয়ার এনায়েতপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।

pbi1

রাকিবকে হত্যার নেপথ্যের কারণ তুলে ধরে পিবিআই প্রধান জানান, ২০২১ সালে ১ জুন ঘটনার দিন রাকিব চম্পার কাছে এক হাজার টাকা চান। টাকা না দেওয়ায় রাকিব তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। পরে তার কাছে ২০ টাকা চাইলে রাকিব ২০ টাকা দিয়ে ২টা মাইলাম ট্যাবলেট কিনে খায়। মাইলাম ট্যাবলেট কিনতে যাওয়ার সময় রাকিব তার মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে যায়। এসময় রাকিবের মোবাইলে রিপা নামের একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ফোন করেন। স্বপ্না ফোনটি রিসিভ করে জানতে পারেন, রিপার সঙ্গেও রাকিবের প্রেমের সম্পর্কসহ শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে। রাকিব বাসায় ফিসে আসলে নওশাদ স্বপ্না রাকিবের কাছে রিপার বিষয়ে জানতে চান। এই নিয়ে তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হলে চম্পা রাকিবের গলায় গামছা পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করেন।

তিনি আরও বলেন, হত্যার পর স্বপ্না তার গুরুমা রুমি হিজড়ার বাসা থেকে চটের বস্তা নিয়ে এসে রাকিবের মরদেহটি ভরে পাশের রুমে রেখে গুম করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ৫ দিন পর প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে সন্ধ্যার পরে এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সে বস্তায় ভরে রাখা ভিকটিমের মরদেহটি নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাসার পাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে রেখে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকেন। পর দিন সকালে স্থানীয় লোকজন বস্তাবন্দি মরদেহ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দিলে চম্পা পালিয়ে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলাকার হিজড়া পল্লিতে গিয়ে নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে আত্মগোপণ করেন।

লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের বিষয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, যশোরের এক গ্রাম্য ডাক্তারের মাধ্যমে দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়ায় রূপান্তর করেন। এই ডাক্তার এমন আরও অনেককেই হিজড়া বানিয়েছেন। তবে কত জনকে করেছেন তার তদন্ত চলছে। লিঙ্গ পরিবর্তন করতে তাকে ১০ হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হয়। আর পুরো চিকিৎসায় তিনি নেন ১ লাখ টাকা। আর এই পুরো চক্রকে ভারত থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন তাদেরই এক গুরুমা।

এমআইকে/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর