শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ঢাকা

কনডেম সেলেই বছরের পর বছর

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০২২, ০৭:২৮ এএম

শেয়ার করুন:

কনডেম সেলেই বছরের পর বছর

দণ্ডবিধিতে অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। নানা অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন অপরাধী। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনেই রায় দেন বিচারিক আদালত। কিন্তু রায় ঘোষণা হলেই কার্যকর হয় না মৃত্যুদণ্ড। এজন্য উচ্চ আদালতের অনুমোদন এবং রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের আপিল নিষ্পত্তির প্রয়োজন হয়। এমন দীর্ঘসূত্রতায় বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি।

কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি আসামি কনডেম সেলে মুত্যুর প্রহর গুনছেন। মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাস্তবায়ন করতে হলে হাইকোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে অনুমোদন বা নিশ্চিতকরণ কতদিনের মধ্যে করতে হবে, তা আইনের কোথাও নির্দিষ্ট করে বলা নেই। বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে দীর্ঘসময় লাগলেও আসামি কিংবা বাদীপক্ষ কেউ কোনো আপত্তি তুলতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে আপরাধীর সাজা দ্রুত কার্যকর না হওয়ায় বাদী ও বিবাদীপক্ষের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে।


বিজ্ঞাপন


কনডেম সেল মূলত অপ্রশস্ত একটি কক্ষ। মৃত্যুদণ্ডের সাজা হলে আসামিকে স্বাভাবিক কারাকক্ষ থেকে নেওয়া হয় কনডেম সেলে। মূলত ফাঁসির রশিতে ঝোলানোর আগ পর্যন্ত ওই কক্ষে রাখা হয় তাকে। তার আগে পার করতে হয় কয়েকটি আইনি ধাপ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র সাত দিনের মধ্যে হাইকোর্টে পাঠাতে হয়। আর সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা কারাগারে থেকে জেল আপিল করতে পারেন। এছাড়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদনও করতে পারেন। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করতে হয়। প্রক্রিয়া শেষে ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল, জেল আপিল ও আবেদনের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড বা খালাসের ছাড়পত্র মিলতেই লেগে যায় বছরের পর বছর।

এসব বিষয়ে নিরসন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি রিট করা হয়। গত ৫ এপ্রিল সে রিটের শুনানি করে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট আসামিকে কনডেম সেলে বন্দি রাখা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এছাড়া কারাবিধির ৯৮০ বিধিটি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

আদালত তার আদেশে দেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে থাকা আসামিদের জন্য কী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা আগামী ৬ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে বলা হয়েছে। কারা মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) প্রতি এ নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।

এরপর আবার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। সেই রায়ের (পুনর্বিবেচনার) রিভিউ আবেদনের সুযোগও রয়েছে। এরপর সংবিধানের অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবশেষে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার ক্ষমা চেয়ে আবেদন করতে পারেন আসামি। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার আবেদন গ্রহণ না করলেই আসামির ফাঁসির সাজা কার্যকর করা হয়।


বিজ্ঞাপন


কিন্তু আমাদের দেশের বিচারিক আদালতে ফাঁসির রায় ঘোষণার পরই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কনডেম সেলে বন্দি রাখা হচ্ছে। তাই এটি চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়।

চূড়ান্ত রায়ের আগে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখা মানবাধিকারের লঙঘন কিনা তার একটি সুনির্দিষ্ট আইন করা দরকার বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত একজন ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামি কনডেম সেলে কেন সাজা খাটবেন। এ বিষয়ে একটি আইন করা দরকার। ফাঁসির সাজা হওয়া পর আসামিকে কনডেম সেলে রেখে বছরের পর বছর রাখার আইন পরিবর্তন করা দরকার। সারাদেশে এমন সাজাপ্রাপ্ত এরকম অসংখ্য বন্দি আছেন। বিচারিক আদালত ফাঁসির সাজা দেওয়ার পর কতদিন পর সেটি কনফার্ম হবে তা বলা মুশকিল। তাই কনডেম সেলে থাকার মেয়াদ নিয়ে একটি আইন জরুরি।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টে সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা ঢাকা মেইলকে বলেন, খুনের দায়ে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তাকে কনডেম সেলে রাখা হয়। এটা আমাদের দেশের আইনের বিধান। তবে যাকে কনডেম সেলে দীর্ঘদিন রেখে আপিল শুনানি করা অমানবিক। কারণ কনডেম সেলটি হচ্ছে ছোট একটি জায়গা।

সাইদ আহমেদ আরও বলেন, কতদিন সময় কনডেম সেলে রাখা হবে সে বিষয়ে আমাদের দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান না থাকলেও ভারতসহ অন্যান্য দেশে আইন আছে। এবং এ বিষয়িটি আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনার কমিটি দেখেন। কমিটি যদি মনে করেন অপরাধী কারাগারে থেকে নিজেকে সংশোধন করেছে, ভালোর পথে ফিরে এসেছে তাহলে তার সাজা কমানোর সুপারিশ করেন। তবে অপরাধী ও ভিকটিম উভয়ের কথা চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা মনে করেন এই আইনজীবী। কারণ যে আসামির দ্বারা একজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার পরিবারের বিষয়টি নজর দেওয়া মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে।

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে রিট করেন তিনজন। তারা হলেন, চট্টগ্রাম কারাগারের কনডেম সেলে থাকা সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান। সিলেট কারাগারে থাকা সুনামগঞ্জের আব্দুল বশির এবং কুমিল্লা কারাগারে থাকা খাগড়াছড়ির শাহ আলম।

রিটে উল্লেখ করা হয় যে, দেশে এখন ২ হাজারের অধিক ফাঁসির আসামি কারাগারগুলোতে কনডেম সেলে রয়েছে। রিটের যুক্তিতে বলা হয় যে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিতে হয়। আবার মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করার বিধান রয়েছে।

এআইএম/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর