রাজধানীর আদাবরের আনোয়ার। কেউ ‘কব্জি আনোয়ার’ আবার কেউ ‘পানি কর্মী আনোয়ার’ হিসেবে চিনে তাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে তিনি পলাতক। কিন্তু এই আনোয়ার সম্প্রতি দুই ব্যক্তিকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছেন। যা ঘটেছে দিবালোকে, সবার সামনে। এ ঘটনায় আহত দুইজনের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। থানায় মামলা হলেও রহস্যজনক কারণে সেই আনোয়ারকে গ্রেফতার করতে পাারছে না পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, তারা তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের আরেকটি ঘটনায় আনোয়ারের নাম আসে। তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাস্টারমাইন্ড হিসেবেই জানে। কিন্তু পুলিশের তাদের চোখে পলাতক। কথিত পলাতক অবস্থায় গত ২ অক্টোবর বিকেলে দুইজনকে কুপিয়ে গুরুর আহত করেন এই আনোয়ার।
বিজ্ঞাপন
ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত ২ অক্টোবর বিকেলে ঢাকা উদ্যান এলাকায় ইট, পাথর, রড ও সিমেন্টের ব্যবসায়ী রুহুল আমিন ও সাজ্জাদ হোসেনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করেন আনোয়ার। ঘটনাটি দিনের বেলায় ঘটলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে রুহুলের দাবি, আনোয়ারের সাথে ওই সময় আরও একজন ছিল, তাকে তিনি চিনতে পারেননি। আর আনোয়ারের সাথে তার কখনো শত্রুতাও ছিল না।
রুহুল আমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, সেদিন একজনের কাছে পাওনা টাকা নিয়ে ঢাকা উদ্যানের অফিসে ফিরছি। আমার অফিসের সামনে এসে সবেমাত্র রিকশা থেকে নেমেছি। ওই সময় পেছন থেকে একজন চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। তখন তার হাত ধরে বলি কোপাচ্ছেন কেন, টাকার ব্যাগ নেবেন? নিয়ে যান। কিন্তু আর একটা কোপও দেবেন না। পরে দ্রুত তার অফিস কক্ষে ঢুকে যান রুহুল। এরপর এলাকাবাসীর কাছে জানতে পারেন তাকে কোপ দেওয়া যুবকের নাম আনোয়ার।
আনোয়ারকে কেন ধরতে পারছেন না এমন প্রশ্নে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। খুঁজে পেলেই ধরব। তবে তার সহযোগীদের ধরতে সক্ষম হয়েছি। তাকেও ধরার চেষ্টা আমাদের অব্যাহত আছে।
রুহুল জানান, তাকে কোপানের সময় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তার কাছে লোনের টাকা নিতে আসা সাজ্জাদ নামে এক যুবক। কব্জি আনোয়ার রুহুলকে কুপিয়ে তার কোমর থেকে কী যেন একটা বের করার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় সাজ্জাদ দৌড়ে এসে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। তখন আনোয়ারের সাথে থাকা এক যুবক আনোয়ারের হাতে থাকা চাপাতি নিয়ে সাজ্জাদকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় ওই যুবকের চাপাতির কোপে নিস্তেজ হয়ে পড়েন সাজ্জাদ। এরপর এলাকাবাসী সাজ্জাদকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র বা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখনো তার চিকিৎসা চলছে। এসব দৃশ্য সেই এলাকার একটি দোকানে থাকা সিসি ক্যামেরায় ওঠে এসেছে। সেই সিসি ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ নিয়ে গেছে।
এলাকাবাসী সূত্রে পাওয়া সিসি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, লাল ও কমলা গেঞ্জি পরা দুই যুবক তাদের কুপিয়ে চলে যাচ্ছে। এদের মধ্যে নীল গেঞ্জি পরিহিত যুবক আনোয়ার আর কমলা গেঞ্জি পরিহিত যুবকটি আনোয়ারের সহযোগী ইউনুস বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
এ ঘটনায় গত ২ অক্টোবরের মোহাম্মদপুর থানায় আহত রুহুলের স্ত্রী বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় দুইজনের নাম উল্লেখ করে বাকিদের অজ্ঞাত হিসেবে দেখিয়ে দেখানো হয়েছে। তবে এই মামলায় এখনো আনোয়ার ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
আনোয়ারের গ্রুপের সদস্যের হাতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাজ্জাদ হোসেন। তিনি মোবাইল ফোনে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাকে যারা মেরেছে তাদের কাউকেই চিনি না। আনোয়ার (পরে তিনি নাম জেনেছেন-তার ভাষ্য) নামে একজন যখন রুহুল ভাইকে কোপ মারছিল, আরেকটা কোপ দেবে, তখন আমি ধাক্কা মেরে ফেলে দিই। আমি কেন তাকে ধাক্কা দিয়েছি এই কারণে তার সঙ্গে থাকা টোকাই চেহারার এক যুবক আমাকে চাপাতি দিয়ে আট থেকে দশটা কোপ দিয়েছে। এতে আমার কোমর, পাছা, হাত ও পিঠে গুরুতর জখম হয়েছে। হাতের অপারেশন হয়েছে। আরও একটা হবে। কিন্তু কয়েক দিন থেকে চিকিৎসক আসছেন না। আমি ভাই গরিব মানুষ। কারও সাথে শত্রুতাও নাই। আমার মা ও আমি কাজ করে খাই। তারা আমাকে এভাবে মারলো!’
সাজ্জাদ বলেন, ‘আমাকে যখন সেই হ্যাংলা পাতলা টোকাই চেহারার ছেলেটা চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছিল তখন তাকে অনুরোধ করছিলাম- ভাই আমার একটা দুই মাসের শিশু সন্তান আছে, মাফ কইরা দেন। তখন সে বলছিল, তোর হাতটা দে। আমাকে তোর হাতটা লাগবো। আমি হাত বাড়ানোর সাথে সাথে আমার হাতে কোপ মারে। পরে পিঠে, পায়ে, পাছায় কোপ মারলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এসময় তারা চলে যায়। পরে লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।’
কে এই আনোয়ার
মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনোয়ার এক সময় পানি বিক্রির কারখানায় কাজ করতেন। পানির জার তুলে ট্রাকে ভরতেন তিনি। এরপর একটি ছিনতাইয়ের মামলায় জেল খেটে বের হওয়ার পর থেকে দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন। আনোয়ার ঢাকা উদ্যান ও নবীনগর ছাড়াও নবোদয় ও বছিলা মেট্রো এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি গা ঢাকা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরতে পারছে না। আনোয়ারের নামে মোহাম্মদপুর থানায় কয়েকটি মামলা রয়েছে।
এলাকাবাসী আরও জানিয়েছে, গত ২ অক্টোবর ঢাকা উদ্যানে রুহুল ও সাজ্জাদকে হামলা করে গুরুতর জখমকারী যুবকের মধ্যে একজন আনোয়ার, আরেকজন ইউনুস। তারা সেদিন তাকে টার্গেট করেই হামলা করেন। বাধা দেওয়ায় সাজ্জাদ হামলার শিকার হন।
এলাকাবাসীর ভাষ্য- শুধু রুহুল ও সাজ্জদই নয়, এরে আগেও গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে মোহাম্মদপুরে আরমান নামের এক যুবকের হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করেন আনোয়ার ও তার গ্রুপের সদস্যরা। পরে তারা আরমানের হাতের কব্জির ভিডিও ধারণ করে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নিজে বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। পরে র্যাব অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- আহমেদ খান (২২), হাসান ওরফে গুটি হাসান (২৪), হানিফ হোসেন জয় (২৪), রমজান (২৩), রাজু (১৯), রাফিদুল ইসলাম রানা ওরফে রাফাত (২৩) ও রাফাতের সহযোগী তুষার হাওলাদার (২৩)। এখন তারা জেলেই আছেন।
এলাকাবাসী সূত্রে পাওয়া সিসি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, লাল ও কমলা গেঞ্জি পরা দুই যুবক তাদের কুপিয়ে চলে যাচ্ছে। এদের মধ্যে নীল গেঞ্জি পরিহিত যুবক আনোয়ার আর কমলা গেঞ্জি পরিহিত যুবকটি আনোয়ারের সহযোগী ইউনুস বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
আনোয়ারের ব্যাপারে র্যাবের ভাষ্য হলো- আনোয়ার এলাকায় আসেন। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কোপ দিয়ে আবারও চলে যান। এছাড়াও আনোয়ার ও তার গ্রুপের সদস্যরা কোনো মোবাইল সিম ব্যবহার করেন না। বিভিন্ন এলাকায় ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড নিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে তারা হুমকি দেন। এরপর দ্রুত সেখান থেকে আবারও চলে যান।
আনোয়ারকে কেন ধরতে পারছেন না এমন প্রশ্নে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। খুঁজে পেলেই ধরব। তবে তার সহযোগীদের ধরতে সক্ষম হয়েছি। তাকেও ধরার চেষ্টা আমাদের অব্যাহত আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, রুহল আমিন নামে এক যুবকসহ দুইজনকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় আনোয়ারের নামে মামলা হয়েছে। আমরা তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তবে গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
এদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ২ অক্টোবরের ঘটনায় ইউনুসকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু আনোয়ারকে তারা খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের ধারণা, আনোয়ার ঘটনার দিনই সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে গেছেন।
এমআইকে/জেবি

