সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মানবপাচার

ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০৩ এএম

শেয়ার করুন:

ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকার আলফাই হোসাইন সজীব। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি এজেন্সির হাত ধরে ক্রোয়েশিয়ায় যান। পাঠানোর সময় এজেন্সি জানায়, তাকে সেখানে একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ দেওয়া হবে। দেশটিতে ওই এজেন্সি যে দালালদের কাছে পাঠায়, তারা তাকে কাজ বুঝিয়ে না দিয়ে উল্টো আটকে রাখে। এরপর দালালরা তার কাছে মুক্তিপণ বাবদ চার লাখ টাকা চায়। টাকা না দিতে পারায় তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। পরে সজীবকে ২০২১ সালের মে মাসে বিদেশি একটি সংস্থার সহায়তায় দেশে ফেরত আনা হয়। এরপর তিনি মানবপাচারের মামলা করলে সেই এজেন্সির চারজনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর তারা জামিনে বের হয়ে সজীবের নামে মিথ্যা মামলা করে। এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিনি ও তার বাবা কারাবরণ করতে হয়।

এ ঘটনায় প্রবাসী মন্ত্রণালয় সজীবকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে সেই এজেন্সিকে নোটিশ পাঠালেও কোনো সাড়া দেয়নি তারা। উল্টো সজীব তাদেরকেই হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করেছেন এজেন্সির মালিক জামাল। 


বিজ্ঞাপন


ভুক্তভোগী সজীব জানান, ফেয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের ওই এজেন্সি (আরএল-১২৬৬) তাকে দুইবার বডি কন্টাক্টে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই ক্রোয়েশিয়ায় পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি। শেষে যখন তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল তখন তড়িঘড়ি করে ক্রোয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু তার আগে তাকে দুইবার দেশটিতে পাঠানো হচ্ছে বলে বিমানবন্দরে পাঠায় ওই এজেন্সি। কিন্তু তার বিএমইটির কার্ড না থাকায় ফেরত আসতে হয়েছে। পরে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন।

তিনি জানান, দেশটিতে গিয়ে মাত্র দুই মাস ১০ দিন ছিলেন। পাঠানোর সময় এজেন্সি জানায়, তাকে সেখানে একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ দেওয়া হবে। দেশটিতে ওই এজেন্সি যে দালালদের কাছে পাঠায়, তারা তাকে কাজ বুঝিয়ে না দিয়ে উল্টো আটকে রাখে। এরপর নির্যাতন করে চার লাখ টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো টাকা দেননি। এক পর্যায় তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় দেশে ফেরত আসতে সক্ষম হন। দেশে ফিরে সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা করেন। এরপর এ ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪। পরে সেই আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। তারা বের হয়েই ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা তাকে ও তার পরিবারকে হয়রানি করতে দুটি মিথ্যা মামলা করেন। তার একটি ছিল নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা। সেই মামলায় তিনি ও তার বাবা জেলও খেটেছেন। যদিও সেই এজেন্সির মালিক বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। 

ভুক্তভোগী আরও জানান, মামলা চলাকালে তিনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি অভিযোগ দেন। অভিযোগের সত্যতা পান বিএমইটির কর্মসংস্থান শাখার উপপরিচালক জহুরা মনসুর। এর প্রেক্ষিতে তিনি সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেন মন্ত্রণালয়ের কাছে। প্রতিবেদনে সুপারিশ করেন, ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিবাসন আইনে মামলা করতে হবে। এরপর ফাইলটি মন্ত্রণালয়ে গেলে সেটি আবারও বিএমইটিতে সমাধানের জন্য পাঠানো হয়। 

হুমকি ও সমাধানের চাপ:


বিজ্ঞাপন


ভুক্তভোগী সজীব জানান, সর্বশেষ গত ৭ জুলাই তাকে শুনানির জন্য বিএমইটিতে ডাকা হয়েছিল। এভাবে প্রতি মাসেই তাকে ডাকা হয়। কিন্তু বিষয়টির সমাধান করা হচ্ছে না। এজেন্সিও তাকে লাখ টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা দিতে চাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ শুনানির দিন তাকে জোর করে এক লাখ টাকায় বিষষয়টি সমাধান টানার জন্যও চাপ দেন বিএমইটি মহাপরিচালক (সাবেক) শহীদুল আলম (বর্তমানে কলকারখানা অধিদফতরে বদলি)। এ বিষয়ে জানতে শহীদুল আলমের ফোনে কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। 

তিনি আরও জানান, সেদিন এজেন্সির পক্ষে কথা বলার জন্য বিএমইটির কর্মসংস্থান শাখার উপপরিচালক আসাদুজ্জামান মোল্লা তাকে চাপ দেন। এছাড়াও অন্যরা তাকে এক লাখ টাকায় বিষয়টা মিমাংসার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। 
 
সজীব ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাকে প্রতি মাসে মন্ত্রণালয়ে ডেকে সমাধানের নামে হয়রানি করা হচ্ছে। এছাড়া আমার নামে দুটি মিথ্যা মামলাও করেছে এজেন্সি। একটি নারী ও শিশু নির্যাতন এবং আরেকটি চেক প্রতারণার মামলা। প্রথম মামলাটির বাদীকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়টি যেহেতু তারাই করেছে সেজন্য প্রথম মামলাটি সেই এজেন্সি ছাড়া আর কেউ করবে বলে মনে হয় না। আমি সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ করে গেলাম কিন্তু তারা আমাকে মাত্র এক লাখ টাকা দিতে চায়! মন্ত্রণালয়ের নোটিশের পরও এজেন্সি ক্ষতিপূরণ দিলো না। উল্টো মিথ্যা মামলা করল। আমি এসবের বিচার চাই। সুষ্ঠ সমাধান চাই। আমার কাছে সব ধরনের ডকুমেন্টস ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকার পরও সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই বিচার আদৌ পাব কিনা সন্দিহান।

তিনি আরও বলেন, আমাকে আজও মিথ্যা মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। আর কতদিন এভাবে হয়রানির মধ্যে জীবন কাটবে? এর কি কোনো সমাধান পাব না। 

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন:

বিষয়টি নিয়ে জানতে ট্রেড ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এর মালিক জামালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি উল্টো অভিযোগ করেন, আলফাই হোসাইন সজীব নাকি তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করছেন।

তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা শুধু তাকে বিমানবন্দরের বহির্গমন পার হওয়ার জন্য কার্ড করে দিয়েছি। এছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ ছিল না। এর বিনিময়ে আমরা তার কাছ থেকে একটা ফি নিয়েছি। 

মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নোটিশের ব্যাপারে জামাল বলেন, নোটিশ এসেছিল কিন্তু কি পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তার কোনো উল্লেখ ছিল না। আর সে তো আমাদের কাছ থেকে তার এক লাখ টাকা ফেরত নিয়েছে। তাহলে আর কিসের টাকা। 

সজীব ও তার পরিবারকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কেন তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করব। আমি তো থাকি ঢাকায় আর সে থাকে চট্টগ্রামে। এমন কাজ জীবনেও করিনি। সে শুনানিতে এসেছিল তখন বিষয়টি জানতে পেরেছি। যিনি এমন মামলা করেছেন তিনিই ভালো জানবেন কেন মামলা করেছেন। বাদীকে খুঁজে বের করলেই তো কেন তিনি মামলা করেছেন তা জানা সম্ভব।

জামালের পক্ষে সাব এজেন্ট হিসেবে টাকা লেনদেনকারী চট্টগ্রামের কামরুল হাসান চেীধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। বারবার চেষ্টা করেও তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। 

এ বিষয়ে  প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরে পরিচয় পাওয়ার পর বলেন, আমি এই মুহূর্তে কথা বলতে পারছি না। একটু পর কল দিয়েন। পরে আবারও কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। শেষে তার মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়, তিনি এরও কোনো জবাব দেননি। অন্যদিকে বিএমইটির ডিপুটি ডিরেক্টর আসাদুজ্জামান মোল্লার ফোন নম্বরে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। পরে চেষ্টা করেও সেটি খোলা পাওয়া যায়নি।

সজীবের মানবপাচারের মামলার ব্যাপারে প্রথম দিকের তদন্তকারী কর্মকর্তা সীতাকুণ্ড থানার এসআই হারুনুর রশিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, সজীব একটা খুবই ভালো ও ভদ্র ছেলে। সে যে মামলা করেছিল সেটির কিছুদিন তদন্তও করেছি। তাকে যে কাজ দেওয়া হবে বলে ক্রোয়েশিয়াতে পাঠানো হয়েছিল সেই কাজ দেওয়া হয়নি। তা তদন্তে পাওয়া গেছে। 

তবে পরের মামলার তদন্তকারী চট্টগ্রাম সিআইডির এসআই মোসায়েদ মোল্লা মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ সজীবের। এ বিষয়ে মোসায়েদ মোল্লার সাথে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। 

এমআইকে/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর