সকাল ১১টা। রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়ির মোড়ে সারিবন্ধভাবে দাঁড়িয়ে ২০টি মোটরসাইকেল। কয়েকটি মোটরবাইকের ওপর বসে আছেন চালক। অন্য চালকের সঙ্গে গল্প করছেন, কেউ আবার মোবাইলে হাতে নাড়াচাড়া করছেন। পাশ দিয়ে কোনো মানুষ গেলেই একেকজন জিজ্ঞেস করছেন ‘ও ভাই, যাবেন নাকি?’, ‘ও ভাই কই যাবেন?।’
অপেক্ষারতরা সবাই রাইড শেয়ারিং করে থাকেন। কেউ ‘পাঠাও’, কেউবা ‘উবার’, ‘ও ভাই’ ইত্যাদি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত আছেন। তবে মন চাইলেই অ্যাপে যাতায়াত করেন। বেশিরভাগই চুক্তিতে চলেন তারা। আর এ জন্যই অপেক্ষা করে খুঁজেন কাঙ্ক্ষিত যাত্রী।
বিজ্ঞাপন
খামারবাড়ি মোড়ের মতো রাজধানীর অনন্ত ১০টি ব্যস্ত জায়গায় শনিবার (১৬ এপ্রিল) রাইড শেয়ারিং করা ব্যক্তিদের যাত্রীর জন্য অপেক্ষা ছাড়াও ভাড়া নিয়ে দামাদামির দৃশ্য দেখা গেছে।
কয়েক বছর আগে রাজধানীবাসীর কাছে যাতায়াতের ভোগান্তি কমাতে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল অ্যাপচালিত মোটরসাইকেল সেবা। কিন্তু সেই সেবাই এখন রূপ নিয়েছে ভয়াবহ যন্ত্রণা আর ভোগান্তিতে। অ্যাপে রাইড না পাওয়া, অতিরিক্ত ভাড়া প্রদর্শন আর বাড়তি কমিশন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, অ্যাপ রেখে খ্যাপেই (ভাড়া চুক্তিতে রাইড শেয়ারিং) বেশি যেতে চায় রাইডাররা। এতে করে অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো কমিশনও দিতে হয় না। ফলে নিজেরাও দাম নির্ধারণ করে ছুটে চলেন গন্তব্যে।

আইন অনুযায়ী অ্যাপের কলেই যাত্রীসেবা দেওয়ার কথা থাকলেও সে আইনের তোয়াক্কা করেন না তারা। নিজেদের আয় এবং সুযোগ-সুবিধা মতো রাইড শেয়ারিং করেন। বিষয়টি অনেকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও এভাবেই চলছে। অবশ্য এতে করে রাইডারদেরও যাত্রীর জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়।
বিজ্ঞাপন
গত দুই দিনেও সরেজমিনে রাজধানীর ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেটের মতো ব্যস্ত জায়গাগুলোতে ঘুরে মোটরবাইকের ওপর বসে যাত্রী খুঁজতে দেখা যায় রাইডারদের। কারওয়ান বাজার থেকে হাতিরঝিল যাওয়ার পথে অন্তত ১৫টি বাইক দাঁড়ানো দেখা যায়। হেঁটে যাওয়া সাধারণ মানুষদের প্রশ্ন করা হচ্ছে কেউ কোথাও যাবে নাকি।
তাহলে অ্যাপে কেন যান না এমন প্রশ্নে সুজন বলেন, দেখুন, আমার দুইটাতে নিবন্ধন আছে, এখন চালাই না। কমিশন দেওয়া লাগে কোম্পানিরে। আবার দেখা গেলো যাত্রীর কল আসছে সেই পান্থপথ থেকে। এখান থেকে যানজট পার হয়ে পান্থপথ থেকে যাত্রী নেওয়ার চেয়ে কিছু কম ইনকামও ভালো।
রাস্তার যানজটের কারণে দূরের যাত্রী আনা যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চুক্তি মানে এখান থেকেই যাত্রীটাকে পেলাম, কোথাও যেতে হচ্ছে না উনার জন্য।’
এদিকে, খামারবাড়ি মোড়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় জুলহাস উদ্দিন নামে এক তরুণ শিক্ষার্থীকে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমি ছুটির দিনগুলোতে শুক্র-শনিবার রাইড শেয়ারিং করি, চুক্তিতেই করি। দিনে দুই-তিনটা ভাড়া যাই মারতে পারি, এতেই আমি খুশি। এতে আমার খরচ হয়ে যায়। অন্য দিনগুলোতে নিজের পড়াশোনার কাজ করি।
একই স্থানে থাকা হাবির মিয়া বলেন, রোজায় তুলনামূলক ভাড়া সপ্তাহের অন্যদিনের চেয়ে শুক্র-শনিবার কমে যায়। অন্য দিনগুলোতেও ভাড়া আগের মতো পাচ্ছি না।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যারা অফিস করেন তাদের বাইরে খুব একটা মানুষ বের হয়নি। এখন ঈদের কেনাকাটা লাগছে, সবাই পরিবার নিয়ে বের হয়। আর পরিবার নিয়ে বের হলে রিকশা বা সিএনজি খোঁজে। তবে ২০ রোজার পর ঈদ যাত্রার ক্ষেত্রে বিভিন্ন টার্মিনালে যাওয়ার জন্য একটা চাপ বাড়বে বলেও জানান হাবিব।
এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে যাত্রীরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে চুক্তিতে। ফলে অনেক যাত্রীরাও এখন ইন্টারনেট খরচ করে অ্যাপে প্রবেশ করে দীর্ঘসময় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে না।

আবু তালেব ফার্মগেটে রাইডের জন্য অপেক্ষায় থাকা একজন। একজন রাইডারের কাছে জানতে চান, ভাই যাবেন বনানী?
অ্যাপে কেন যাচ্ছেন না জানতে চাইলে তালেব বলেন, দেখুন আমরাতো অনেকদিন ধরে এভাবেই যাই। বাসা থেকে বের হলেই গাড়ি পাই, অ্যাপে কল দিলে কোথা থেকে আসবে তার ঠিক নাই। দেখা গেছে গাড়ি আসতেই আরও আধা ঘণ্টা, ততক্ষণে আমি অনেকটাই চলে যাবো। ভাড়াও বেশি না বরং অনেকসময় কমই হয়।
বিষয়টি কতটুকু নিরাপদ সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরাপদ নয়, এটি ঠিক। আবার একটু ভিন্নভাবে দেখলে ততোটা অনিরাপদও বলা যাবে না। কেননা এই দিন-দুপুরে আমি সেলিব্রেটি নই, আমি শহর চিনি সবমিলে আসলে আমি এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এক রাইডারের সঙ্গে দুইশ টাকার ভাড়া চাওয়ার পর ১৫০ টাকায় মিটিয়ে গন্তব্যে ছুট দিলেন তিনি।
চুক্তিতে শ্যামলী যাওয়া মিরাজ উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, এই ঢাকায় এক মিনিট অপেক্ষা করার সময় নাই। এ কারণে অ্যাপের জন্য অপেক্ষা করি না। ডাকাডাকি করে ভাড়া মিটাইয়া রওনা দেই। যারা নিরাপদ মনে করে না, তারা যাবে না। আমাদের সমস্যা হয়নি, আশা করি আল্লাহর রহমতে কোনো সমস্যা হবে না।
তবে রাতের বেলায় চুক্তিতে যাই না জানিয়ে মিরাজ বলেন, কেউ কেউ অ্যাপে কল করলে চুক্তিতে যাওয়ার আগ্রহ দেখান, নয়তো কল কেটে দেন তিনি।
রোজার মাঝামাঝি সময়ে এসে দেখা গেছে, বিভিন্নস্থানে রাইডারদের দীর্ঘ অপেক্ষা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সকালে আর দুপুরের পর যাত্রীর চাপ বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন রাইডাররা। এর মাঝের সময়, এমনকি ইফতারের পর আর তেমন কোনো যাত্রী পাওয়া যায় না।
এদিকে, সকালে অফিস টাইমে আবার বিকেল অফিস ছুটির সময়ে সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকে, ফলে একটু দূরত্ব হলেই একাধিক ট্রিপ দেওয়া যায় না। তাই পিক আওয়ারে ভাড়া একটু বেশি হয় বলেও জানিয়েছেন একাধিক চালক।
অন্যদিকে, পিক আওয়ারের ভাড়া নিয়ে সকালে এবং বিকালে কোনো কোনো যাত্রীকে তর্কেও জড়াতে দেখা গেছে। আর চালকদের স্রেফ উত্তর, ‘গেলে যান, না গেলে নাই।’
গুলশান মোড়ে তর্কে জড়ানো এক যাত্রী বলেন, ‘দেখুন একতো রমজান মাস, আমি মগবাজার অ্যাপে ১৪০ টাকা ভাড়া দেখাচ্ছে। অ্যাপে কল দিলে রাইডার আসতে দেরি হবে বলে চুক্তিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওরা ২৫০ টাকা চাইলো, এত বেশি কেন চাচ্ছেন বলাতেই ক্ষেপে গেলো, দেখলেনইতো বাকিটা...।
তবে মোটরসাইকেল রাইডাররা বলছেন, অ্যাপের মাধ্যমে গেলে তাদের লাভ একেবারেই হয় না। পরিশ্রমের একটা অংশ দিতে হয় কোম্পানিকে কমিশন হিসেবে। এর বাইরে অ্যাপে যাত্রীর কল পেতেও দেরি হয়, আবার যাত্রীর কাছে পৌঁছাতেও সময় লাগে। যাত্রীকে খুঁজতে হয়, সময় নষ্ট হয়। তাই চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহনই পছন্দ তাদের।
তবে রোজায় আয় কমেছে উল্লেখ করে শাহবাগে অপেক্ষারত রাইডার শাহিন রহমান (৩২) বলেন, রোজার আগে চুক্তিতে মাসে ২০ বা একটু বেশি আয় হতো। আয়টা আসলে আপনি যেমন ট্রিপ মারতে পারবেন তার ওপর নির্ভর করে। প্রতিদিন ৮০০ থেকে হাজার টাকার ট্রিপ মারা যেত। এখন পাঁচ থেকে ৬০০ টাকার ট্রিপ মারাও কষ্ট হয়ে যায়। তবে রোজার শেষের ১০ দিন ভালো আয় হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

শাহিনের সঙ্গে থাকা চালক সুমন (২৮) বলেন, আমার একটা ছোট দোকান ছিল। বন্ধ হওয়ার পর এই মোটরসাইকেলের ওপরই সংসার চলছে।
রোজাতে আয় কমার কারণ হিসেব তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর ট্রিপ না পাওয়া একটা বড় কারণ। অন্য সময়গুলোতে সন্ধ্যার পরও রাত ১০টা পর্যন্ত মানুষ এদিক-সেদিক যাতায়াত করে। আর রোজায় সবাই সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে ফিরতে চান, পরে তারাবি পরে বাইরে বের হয় না। এতে করে সময় কমেছে আমাদের কাজের। তবুও বাকি দিনগুলোতে আয় করে ঈদের বাড়িতে ছুট দেওয়ার কথা জানান সুমন।
এদিকে, যাত্রী ও সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চুক্তিভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার কারণে রাজধানীতে অনেক দুর্ঘটনা ছাড়াও ছিনতাইয়ের মতো নানা দুর্ঘটনাও হচ্ছে। তবুও মানুষ জেনে-বুঝেই চুক্তিতে যাচ্ছে। আর রাইডাররা বলছেন, আমরা কাউকে জোর করি না যাওয়ার জন্য। আমরা ভাড়া মারি, টাকা পাই। কাউকে বিপদে ফেলা উদ্দেশ্য নয়। যারা এ ধরনের কাজ করে, চুক্তিতে নিয়ে বিপদে ফেলে তাদের লক্ষ্যই বিপদে ফেলা।
অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তারাও মনে করেন, চুক্তিতে গাড়িতে যাতায়াত নিজের জন্যই ঝুঁকি। এ ক্ষেত্রে সবার সচেতনতার বিষয়ে গুরুত্ব দেন তারা।
এর আগে অবৈধ রাইডারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল বিআরটিএ। বিষয়টির সুরাহা নিয়ে বিআরটিএ, অ্যাপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আলোচনাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। যাত্রী সাধারণসহ সবার প্রত্যাশা সুষ্ঠু নীতিমালার মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক অ্যাপভিত্তিক এই সেবায়। পাশাপাশি নিরাপদ হোক যাত্রা। সঙ্গে রক্ষা হোক চালকদের স্বার্থও।
ডব্লিউএইচ/আইএইচ

