রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘শেষ দিনগুলোতে মায়ের অবলম্বন ছিলাম আমি’

অনামিকা মনি
প্রকাশিত: ১৪ মে ২০২৩, ১১:২৭ এএম

শেয়ার করুন:

‘শেষ দিনগুলোতে মায়ের অবলম্বন ছিলাম আমি’

মা আমার মা। জীবনের বিশাল একটি অংশ জুড়ে রয়েছেন যিনি। ছোটবেলা থেকেই মা কে ভয় পেতাম ভীষণ। কারণ সেরকম শাসনের মধ্যে রাখতো আমাকে। কোথাও যেতে দিতো না, কারোর সঙ্গে মিশতেও দিতে চাইতো না। বিশেষত, বিপরীত লিঙ্গের মানুষের থেকে আগলে রাখতো সবসময়। তখন খুব রাগ হতো, অভিমান হতো মায়ের ওপর। মনে হতো মা বোধহয় আমায় ভালোইবাসে না।

যখন দুনিয়াটা চিনতে শিখলাম, বুঝতে শিখলাম ভালোভাবে, দুনিয়ার কিছু মানুষের কদর্য রূপ দেখতাম, তখন বুঝলাম মা তার মেয়েকে কেন এতোটা আগলে রাখতেন। মায়ের গভীর ভালোবাসা কাকে বলে বুঝতাম তখন। মায়ের ভালোবাসা আরও গভীরভাবে বুঝে উঠার আগেই হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো আমার। তাও ছিল প্রেমের বিয়ে। মায়ের ভয়ানক আপত্তি ছিল কিন্তু মেয়ের জেদের কারণে মা ও হার মেনে নেন।  


বিজ্ঞাপন


anamika

আমার বিয়ের পরই আমি বুঝতে পারলাম পরিপূর্ণভাবে কতো বেশি ভালোবাসে আমায় মা। অসহায়ের মতোন হয়ে গিয়েছিলেন মা আমার। শুধু কান্না করতেন আর বলতেন তোর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমার ঘর এভাবে খালি হয়ে যাবে কোনদিন ভাবতেও পারিনি। কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম মায়ের কাছে। সারাদিন মায়ের সাথে কাটিয়ে কলেজ ছুটির সময়ে চলে আসতাম বাসায়। বলিনি কখনো শ্বশুরবাড়িতে। বলিনি কখনো নিজের স্বামীকেও। হয়তো সংকোচে, হয়তো ভয়ে।

মা মেয়ের সারাদিন কতো গল্প, কতো খুনসুটি। দুপুরে মা নিজের হাতে মেখে ভাত খাওয়াতেন আমাকে। অনেক সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতাম বাবার বাসায়। ঘুম ভাঙলে মা বলতেন আমায়- ‘কীভাবে অসহায়ের মতোন ঘুমাচ্ছিস তুই। বড্ড মায়া লাগছে রে’। মায়ের সবসময় চিন্তা ছিল শ্বশুরবাড়িতে আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো! আমি হেসে বলতাম, ‘মা তোমার মেয়ে অনেক ভালো আছে। চিন্তা করো না’। তখন ভাবতাম মায়েরা বুঝি এমনই ভালোবাসাময় হয়?

anamika


বিজ্ঞাপন


একটু অসুখ হলেই কী যে করতো মা! আর আমি বিরক্ত হলে বলতো, ‘নিজে মা হলে বুঝবি সেদিন’। আমি বুঝি মা। এখন সব হাড়ে হাড়ে বুঝি। কিন্তু তোমাকে বলতে পারি না আর আমার অনুভূতিগুলো। 

মেয়ের জামাই মেয়েকে নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যেত দেখে মায়ের সে কী আনন্দ! বলতো শুধু, ‘মা রে, ঘুরে নে। আমাকে তো তোর বাবা ঘুরাতে নেয়নি। তুই ঘুরে বেড়া’। আমার সন্তান হতে দেরি হচ্ছিল বলে কতো কান্নাকাটি করতো ঠাকুরের কাছে। কতো মানত করতো এখানে ওখানে। সেসময় আমি কিছু শারীরিক কষ্টে ভুগছিলাম দেখে মায়ের কতো কান্নাকাটি আমার জন্য। ঠাকুরকে বলতো শুধু, ‘আমার মেয়ের কষ্টগুলো আমায় দাও ঠাকুর। ওকে তুমি সুস্থ রাখো’। 

anamika

হয়তো মা বলেই ওমন করে বলতে পারতো। মায়ের যখন ক্যানসার ধরা পড়ল তার ২ মাস ৩ দিনের মাথায় মা মারা গেলেন। শেষ দিনগুলোতে মায়ের অবলম্বন ছিলাম আমি। আমাকে ছাড়া খাবে না, কাপড় চেঞ্জ করবে না। একটু না দেখলে অস্থির হয়ে যেত মা। একদিন মায়ের প্রস্রাবের ক্যাথেটারটা খুলে ওয়াশ করিয়ে দিতে সংকোচ করছিলাম দেখে মা বলছিলেন, ‘মা রে আজ থেকে তুই আমার মা, আমি তোর মেয়ে। এই জরায়ু থেকেই তোর জন্ম। আজ তা তোর কাছে উন্মুক্ত’। ভেউভেউ করে কান্না করেছিলাম সেদিন মা কে জড়িয়ে ধরে।

মা মারা যাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম চরমভাবে। সবাই ঘুমাতো আর আমি জেগে থেকে কান্না করতাম শুধু। আর হয়তো তাই মা আমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমার শরীরে মাতৃত্বের স্বাদ এনে দিলো। আজ আমার দুটো সন্তান। কিন্তু কেউ আমার মা কে দেখল না। এটাই আমার জীবনের বড় দুঃখ। সন্তান হিসেবে অনেক দায়িত্বই পালন করতে পারিনি, কতো কষ্ট দিয়েছি। মাকে কারণে অকারণে এখন আর চাইলেও তা শোধরাতে পারবো না। জানি আর সেটাই বড্ড খোঁচা দেয় বিবেকে।

anamika

আজ ১৬টা বছর মা কে ছাড়া আমি! আমার ছেলেরাও বড় হয়ে গেছে অনেক। তাও মা কে মিস করি প্রতিটা মুহূর্তে। কান্না পায় মা কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বসলে। আমার ছেলেদেরকে মায়ের কতো কতো গল্প শোনাই। এখন ওরাও ওদের না দেখা দিদিমাকে নিয়ে জেনে গেছে অনেককিছুই। আমি জানি আমার মা ঠিক আশীর্বাদ করছে আমাদের সবাইকে আকাশের তারা হয়ে গিয়েও।  

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর