রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

রঞ্জনার ‘মিঠাইকুঞ্জ’: ঐতিহ্যবাহী সাবিত্রী-রসকদমের ঠিকানা 

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১৮ পিএম

শেয়ার করুন:

রঞ্জনার ‘মিঠাইকুঞ্জ’: ঐতিহ্যবাহী সাবিত্রী-রসকদমের ঠিকানা 

‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোড়া করে দেবো, বলেছে পাড়ার দাদারা/ অন্যপাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই… রঞ্জনা আমি আর আসবো না এখানে, রঞ্জনা আমি আর আসবো না।’— অঞ্জন দত্ত কোন রঞ্জনার পাড়ায় আর না যাওয়ার কথা বলেছেন তা ঠিক জানি না। তবে রঞ্জনা চাকমার পাড়ায় আপনি নির্দ্বিধায় যেতে পারেন। মিষ্টিমুখ করতে পারেন দেড়শ বছরের পুরনো সাবিত্রী মিষ্টি দিয়ে। 

একটু খুলেই বলি। রাঙ্গামাটির মেয়ে রঞ্জনা চাকমা। বর্তমানে তিনি থাকেন মেহেরপুরে। সেখানকার বিখ্যাত মিষ্টি সাবিত্রী, রসকদম বিক্রি করেন অনলাইনে। খাবারের অনলাইন প্রতিষ্ঠান ‘মিঠাইকুঞ্জ’র কর্ণধার তিনি। রঞ্জনার মেয়েবেলা, ব্যবসায় আসার মিষ্টি সব গল্প নিয়ে আড্ডা হয় ঢাকা মেইলের সঙ্গে। জানা যায় কীভাবে উদ্যোক্তা খাতায় নাম লিখিয়েছেন এই নারী। 


বিজ্ঞাপন


ranjana

রাঙামাটিতে জন্ম রঞ্জনার। শৈশব, কৈশোর সেখানেই কাটে। ছাত্রী হিসেবে বেশ ভালো ছিলেন তিনি। ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করে রঞ্জনা বলেন, ‘ক্লাস ওয়ানের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হয়েছিলাম। রোল কেন এক হলো সেজন্য কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছি। স্যার সবাইকে কত কত রোল দিয়েছেন। অথচ আমাকে কিনা দিলেন মাত্র ১! এখনও এই ঘটনা নিয়ে আমাকে পরিবারের মানুষ খ্যাপান।’

আনন্দে ভরপুর শৈশব কাটান রঞ্জনা। বেশিরভাগ পরিবার যেখানে প্রথম সন্তান ছেলে কামনা করা হয়, সেখানে তার বাবা কন্যা সন্তানের আশা করেছিলেন। আর তাই বাবা-মায়ের আদরেই কেটেছে জীবনের প্রাথমিক দিনগুলো। 

ranjana


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করছেন রঞ্জনা। তবে আগে ভিন্ন পেশায় ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি করতেন টিউশন। বিএ পরীক্ষার পর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর ‘দৃঢ় সূচনা’ প্রজেক্টে ৯/১০ মাস কাজ করেন। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এনজিওতে প্রায় ১১/১২ বছর চাকরি করেছেন শিক্ষা সেক্টরে।

শিক্ষকতা ছেড়ে অনলাইন ব্যবসায় কীভাবে? জানতে চাইলে রঞ্জনা বলেন, ‘অনলাইন ব্যবসায় আসার কোনো ইচ্ছে আসলে ছিল না। তবে আমি অনলাইনে কেনাকাটা করতাম। এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিশ্বস্ত পেজ আর গ্রুপ ছিল ভরসা। সেই সূত্রেই ২০১৮ সালের শেষের দিকে অনলাইন পোশাক প্রতিষ্ঠান ‘চৌরঙ্গী’র সঙ্গে যুক্ত হই। কেনাকাটা আর ফেসবুক অ্যাক্টিভিটির কারণে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ঈশিতা পায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।’

ranjana

‘ব্যবসার জন্য ঈশিতা আমাকে ভীষণ উৎসাহ দিত। কিছু একটা করতে বলত। কিন্তু আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। বলতাম ধুর এসব ব্যবসা আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। বার বার বলতো। যাইহোক, তার সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে পূজা পার্বণ কিংবা বিশেষ দিনে উপহার আদান-প্রদান হতো। তো একবার আমি মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি সাবিত্রী আর রসকদম পাঠিয়েছিলাম। তারা খুব পছন্দ করল। এই দুই পণ্য নিয়ে ব্যবসা করার কথা বলল ঈশিতা। আমি গড়িমসি করে কদিন কাটালেও নাছোড়বান্দা ঈশিতার কাছে হেরে গেলাম। শুরু হলো আমার নতুন যাত্রা। ঈশিতা আর আমার স্বামী দুজন মিলেই প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক করল মিঠাইকুঞ্জ’— যোগ করেন রঞ্জনা। 

২০২২ সালের ১৩ মার্চ ব্যবসা শুরু করেন এই নারী। কিছুদিন আগেই সফলতার সঙ্গে এক বছর পার করেছে তার প্রতিষ্ঠান। কী কী পণ্য নিয়ে কাজ করেন রঞ্জনা? জানতে চাইলে তিনি জানান মিঠাইকুঞ্জতে পাওয়া যায় সাবিত্রী, রসকদম, মিক্সড ডালের বেসন, হোম মেইড ঘি। পাশাপাশি আমের সিজনে আমের খোসাসহ আচার, মোরব্বা, আমসত্ত্ব বিক্রি করেন তিনি। বিলিম্বি কিংবা আনারসের মতো ফল দিয়েও আচার তৈরি করেন তিনি। ক্রেতাদের কাছে এসব আচারের চাহিদাও বেশ। 

ranjana

সারা বছরজুড়ে সাবিত্রী আর রসকদমের চাহিদা থাকে ক্রেতাদের কাছে। আমসত্ত্ব তার অন্যতম বেশি বিক্রীত পণ্য। রমজানে বেশি বিক্রি হয় বেসন। এছাড়া স্বাস্থ্যসচেতন ক্রেতারা কেনেন হোমমেড ঘি আর মসলা। 

এসব পণ্য নিয়ে তো বর্তমানে অনেকেই কাজ করছেন। তাহলে ক্রেতা কেন মিঠাইকুঞ্জই বেছে নেবেন? প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই রঞ্জনাকে। উত্তরে মিষ্টি হেসে তিনি বলেন, ‘আমি খাঁটি জিনিস নিয়ে কাজ করি। এই যেমন, সাবিত্রী, রসকদম এই দুটি মিষ্টি অনেক দোকানে পাবেন। কিন্তু আমি যেখান থেকে এই মিষ্টিগুলো সরবরাহ করি সেটি ১৫০ বছরের পুরানো রেসিপিতে করা যা সেই ব্যক্তির নাতিরা করছেন। এবং এনাদের আলাদা কোন কারিগর নেই। যে কারণে খাঁটি জিনিসটাই সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারছি। ঘি আমি নিজে বানাই। এখন পর্যন্ত যারা নিয়েছেন তারা আর কারো কাছ থেকে নেননি। আচার, পাহাড়ি হলুদ যেটাই বিক্রি করি না কেন একদম সেরাটাই দিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।’

ranjana

উত্তরে বোঝা গেল নিজের কাজ ও পণ্যের বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী এই নারী। অনলাইন ব্যবসায় যেটি বেশ জরুরি। ৩ হাজার টাকা মূলধনে ব্যবসা শুরু করেন রঞ্জনা। প্রথম বছরটিকে পরিচিতি বাড়ানো আর ক্রেতার আস্থা অর্জনের জন্য বরাদ্ধ রেখেছিলেন। দুটো কাজেই বর্তমানে সফল বলা যায় তিনি।

ব্যবসা ক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা খুব ভাল পেয়েছেন রঞ্জনা। বিশেষ করে তার স্বামীর। রঞ্জনা বলেন, ‘ও সাপোর্ট না দিলে তো বিজনেস শুরুই করতে পারতাম না। প্রতিটা পদে পদে সাথে ছিল। বাজার করা থেকে প্যাকেজিং, ডেলিভারি সব কাজেই সে ছিল ছায়ার মতো। আর হ্যাঁ মিঠাইকুঞ্জের লোগোটাও তারই ডিজাইন করা। আর আমার সাথে রাত জেগে কাজ করাও ছিল তার অন্যান্য কাজের মতো রুটিন মাফিক। পরামর্শদাতা হিসেবেও পেয়েছি তাকে।’

ranjana

‘আরেকজন পরামর্শদাতার নাম না নিলেই নয়। সে হলো ঈশিতার স্বামী সুমন। যাকে আমি ছোট ভাই হিসাবেই দেখি। বিজনেসের ছোটখাটো বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে সে আমাদের পথ প্রদর্শকের কাজ করে এখনও হাসি মুখে। আমরা ঈশিতা-সুমনের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব’— যোগ করেন তিনি।  

আগেই বলেছিলাম কাজের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী এই নারী। প্রতিদিন নতুন উদ্যমে কাজ করে যান। অবসর সময়ে প্রতিষ্ঠান নিয়ে নানা আইডিয়া সাজান। কীভাবে মিঠাইকুঞ্জকে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, কীভাবে ক্রেতাদের আরও ভালো পণ্য দেওয়া যায়— এসব চিন্তা মাথায় থাকে সবসময়ই। 

নিজের উদ্যোগকে ভালো অবস্থানে নিতে চান রঞ্জনা। যেন সবাই একনামে মিঠাইকুঞ্জকে চিনেন। স্বপ্ন দেখেন মিঠাইকুঞ্জ আরও বড় হবে।

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর