সময় চলে গেলেও তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে যায়। জীবনে আসা কঠিন সময়গুলো মানুষকে শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলে চলার বিদ্যা শেখায়। গয়নার অনলাইন প্রতিষ্ঠান ‘ডলস ওয়ারড্রব বাই সিনদিয়া’র কর্ণধার সিনদিয়া আরা সুলতানা। জীবনের নানা কষ্টের স্মৃতি সঙ্গী করে যিনি আজ একজন অনলাইন উদ্যোক্তা। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আড্ডায় তিনি জানান ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যবসায়িক জীবনের নানা গল্প।
দাদার পরিবারের কেউ তেমন পছন্দ না করায় নানাবাড়িতে বড় হন সিনদিয়া। এসএসসি পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। বড় মেয়ে হওয়ায় বাবার কাছে ভীষণ আদরের ছিলেন সিনদিয়া। যা চেয়েছেন তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন সবসময়। ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পড়ে এরপর অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি দেন। এইচএসসি সমাপ্ত করেন ইম্পেরিয়াল থেকে। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং ও বিজনেস ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করেন সিনদিয়া।
বিজ্ঞাপন
২০১২ তে টার্কে থেকে আসার পরেরদিন তিনি বাবাকে হারান। জীবনের অনেক বড় ধাক্কা ছিল সেটি। বাবার মৃত্যুর পর সবকিছুই খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সেমিস্টার ফি থেকে শুরু করে হাত খরচ সবকিছু জন্য মামা-চাচাকে কৈফিয়ত দিতে হতো। নিজস্ব গাড়ি থাকলেও প্রায়ই বাধ্য করা হতো সিএনজি ব্যবহার করে যাতায়াত করায়। সবকিছু মিলিয়ে ডিপ্রেশনে চলে যান সিনদিয়া। হতাশ হয়ে পড়েন। যার প্রভাব পড়ে পরীক্ষার ফলেও।
২০১৩ সালে নিজের হাত খরচের অর্থ জোগাড় করতে চায়না থেকে অল্প স্বল্প পণ্য এনে অনলাইনে বিক্রি করা শুরু করেন। তবে সেসময় অনলাইন মার্কেটের অতটা চল না থাকায় তাকে প্রচুর স্ট্রাগল করতে হয়। এরপর বড় চাচীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি লনের থ্রিপিস এনে বিক্রি করা শুরু করেন। আপন মানুষদের কাছ থেকে অনেকসময় কেনা দামও পাননি। তবু ব্যবসা চালিয়ে গেছেন সিনদিয়া।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে গয়না নিয়েই কাজ করছেন সিনদিয়া। শুরুতে ভারত/চায়না/থাইল্যান্ড থেকে গয়না এনে বিক্রি করতেন। তবে এখন নিজেই ডিজাইন করে গয়না তৈরি করে থাকেন। ১৬ জন কারিগর তার তত্ত্বাবধায়নে কাজ করেন। এই পুরো যাত্রা পথে তার পাশে আছেন স্বামী। যার শতভাগ সহযোগিতায় সিনদিয়া কাজের উৎসাহ পান, শক্তি পান।
সিনদিয়ার কাছে জানতে চাই, পেজের নাম ডলস ওয়ারড্রব বাই সিনদিয়া হওয়ার কারণ কী? তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমি শুরু থেকে অনেক রকম প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করেছি তাই ওয়্যারড্রব নামটা রেখেছি। কারণ মেয়েদের ওয়ারড্রবে সবরকম প্রোডাক্ট থাকে যা দিয়ে তারা সাজগোজ করে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলে। আর যেহেতু আমি ছোট ছিলাম নিজেকে পুতুল মনে হতো তাই ঐখান থেকে এই নাম। মেয়ে মানে পুতুল, পুতুলের আলমারি থেকে ডলস ওয়ারড্রব।
শুরুতে অনেক কিছু কাজ শুরু করলেও ২০১৮ থেকে কেবল গয়না নিয়ে কাজ করেন সিনদিয়া। সব নিজেই সামলাতেন। ২০১৯ সালে কনসিভ করলে স্বামী সাহায্য করা শুরু করেন। বর্তমানে বাইরের কাজ স্বামীই সামলান আর ইনডোরের কাজ সিনদিয়া।
৫০ ডলার যা তখনকার সময়ে ৪০০০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন সিনদিয়া। বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূলধনও বেড়েছে। মাসে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ২/৩ লাখ টাকা পর্যন্তও আয় করেন সিনদিয়া।
পরিবার থেকে কখনোই কোনো সহযোগিতা পাননি সিনদিয়া। বরং শুনে এসেছেন এত স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে শেষমেশ অনলাইন ব্যবসা। সিনদিয়া বলেন, ‘আমার মামী তার বোনকে নিয়ে অনেক গর্ব করে সে ১ লাখ বেতন পায় চাকরি করে। আমার ফুপি তার মেয়েকে নিয়ে গর্ব করে সরকারি চাকরি করে এই জন্য। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই প্রশাসনে সরকারি চাকরিতে অব্যাহরত। একমাত্র আমি আর আমার হাজব্যান্ড ব্যবসা করছি।’
তবে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট সিনদিয়া। তিনি বলেন, ‘আলহামদুল্লিল্লাহ্ আমরা সফল। আজকে মানুষ আমাকে, আমার পেইজকে চিনে আমার কাজ দিয়ে। আমার বাবার পরিচয়ে না। আমার বাবার ব্যবসা দিয়ে আমার মামা-চাচারা চলছে যেটাতে আমি কাজ করতে গেলে আমার চাচা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং মারতে আসে। আমি আমার বাবার ব্যবসাকে হারাতে দিবো না। এর যথাযথ ব্যবস্থা নিব খুব শীঘ্রই। এতিমের হক মেরে তো কেউ বড় হতে পারবে না।’
গয়নার ব্যবসার পাশাপাশি সিনদিয়া একজন মেকআপ আর্টিস্টও। এই কাজটিও প্রায়ই করে থাকেন তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠানকে ব্র্যান্ড হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখেন এই নারী। একদিন এই প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য মানুষ কাজ করবে, তার তৈরি গয়না দেশের বাইরে নাম করবে—এমনটা প্রত্যাশা করেন।
এনএম