মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

রমজানে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয়, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৫৮ এএম

শেয়ার করুন:

রমজানে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয়, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

পবিত্র মাহে রমজান মাসে রোজা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। কিন্তু রোজায় ডায়াবেটিস রোগীরা কিছুটা অসুবিধায় পড়েন। তারা বুঝে উঠতে পারেন না ঠিক কোন নিয়মে বা কীভাবে রোজা রাখবেন। একজন ডায়াবেটিস রোগী নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চললে সুস্থভাবেই রমজান পার করতে পারেন। 

রোজার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা


বিজ্ঞাপন


রোজা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, রক্তচাপ কমায়, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। এটি ওজন কমায়, রক্তের খারাপ চর্বি কমায়, লিভার এবং পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে। রোজা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। 

ডায়াবেটিস রোগ কী? 

মানুষের শরীরে প্রতিটি কোষের বেঁচে থাকা এবং কাজ করার জন্য গ্লুকোজ প্রয়োজন। আমরা খাবারের মাধ্যমে যে গ্লুকোজ পাই সেটা রক্ত থেকে এই কোষগুলোতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইনসুলিন দরকার হয়। যদি কখনো এই ইনসুলিন ভালোভাবে কাজ করতে না পারে অথবা শরীরে ইনসুলিনের অভাব থাকে তখন শরীরের কোষগুলো গ্লুকোজের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অপরদিকে কোষগুলোতে প্রবেশ করতে না পেরে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং এটা রক্ত প্রবাহ বাধা গ্রস্থ করে। এটাকেই ডায়াবেটিস মেলাইটাস বলে যেটাকে আমরা ডায়াবেটিস বলে জানি। 

যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ব্রেইন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, হাতে পায়ে পচন ধরা ইত্যাদির ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। কিন্তু ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলে এইসব ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে আসে। রমজান মাসে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।


বিজ্ঞাপন


রমজান পূর্ববর্তী একজন ডায়াবেটিস রোগীর করণীয় 

একজন ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই রমজানের অন্ততপক্ষে তিন মাস পূর্বে থেকে তার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত এবং রোজার ব্যাপারে পরিকল্পনা করা উচিত। এটাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে রোজার এক মাস পূর্বে এবং সেটাও কোনো কারণে না হলে অন্ততপক্ষে দুই সপ্তাহ পূর্বে অথবা রোজার আগে যখনই সম্ভব হয় অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা, রোগের ইতিহাস, ডায়াবেটিস থেকে জটিলতার সম্ভাবনা এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ বিবেচনায় তাকে যথোপযুক্ত পরামর্শ দিবেন।

একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে এই বিষয়গুলো প্রত্যেকটা রোগীর জন্য আলাদা আলাদা হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক রোগীকে তার নিজ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

রোজায় ডায়াবেটিস রোগীর যেসব জটিলতা হতে পারে 

হাইপোগ্লাইসেমিয়া অথবা সুগার অতিরিক্ত কমে যাওয়া, হাইপারগ্লাইসেমিয়া অথবা সুগার অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পানি শূন্যতা দেখা দেওয়া ইত্যাদি।

ডায়াবেটিস রোগী যাদের রমজানে রোজা রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ 

 ডায়াবেটিসের পাশাপাশি গুরুতর অন্য কোন রোগ যেমন: হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক
 বিগত তিন মাসের মধ্যে সুগার অতিরিক্ত কমে অথবা বেড়ে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টির ইতিহাস
 ঘনঘন শরীরের গ্লুকোজ কমে যাওয়া
 গ্লুকোজ কমে গেলেও কোন উপসর্গ না হওয়া
 অনিয়ন্ত্রিত টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস
 দীর্ঘমেয়াদি ডায়ালাইসিস এর রোগী
 গর্ভবতী মা যিনি ইনসুলিন পাচ্ছেন।

রোজায় ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়াম

রোজা রাখা অবস্থায় দিনের বেলা ব্যায়াম করা উচিত নয়। ইফতারের কিছুক্ষণ পর ব্যায়াম করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে রমজানে যে তারাবিহ নামাজ হয় সেটাই একজন ডায়াবেটিস রোগীর ওইদিনের ব্যায়াম হিসেবে যথেষ্ট। সাথে মসজিদে হেঁটে যাওয়া এবং হেঁটে আসলে আর অতিরিক্ত ব্যায়াম করার দরকার নেই।

রোজায় ডায়াবেটিস রোগীর খাবার 

রোজার আগে এবং পরে একজন ডায়াবেটিস রোগীর মোট ক্যালোরি গ্রহণ প্রায় একই থাকবে যেটা রোগী চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে নিবেন। ইফতারিতে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া ঠিক না। এতে করে ইফতারের পরে সুগার বেড়ে যেতে পারে। নিয়মের মধ্যে ইফতার যত দ্রুত সম্ভব এবং সেহরি যত দেরিতে সম্ভব খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইফতারি থেকে সেহরির মধ্যে প্রচুর পানি পান করতে হবে যেটা পানি শূন্যতা প্রতিরোধ করবে। 

রাতের খাবার এবং সেহরি মিস করা যাবে না। ইফতারির পর ভাজাপোড়া খাবার পরিহার করা উচিত। অথবা খুবই সামান্য পরিমাণে যেমন ১-২টা বেগুনি, ১-২টা একটা আলুর চপ, ১-২ টুকরা পিঁয়াজু, ২-৩ কাপ মুড়ি, অল্প একটু বুটভুনা খাওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই সেটা বাসায় তৈরি হতে হবে। 

ইফতারিতে একটা বড় খেজুর অথবা দুটি ছোট খেজুর, মিষ্টি জাতীয় ফল যেমন তরমুজ ছোট এক দুই টুকরা খাওয়া যাবে, মিষ্টি নয় অথবা টক জাতীয় ফল ইচ্ছামত খাওয়া যাবে। ফলের শরবত খাওয়া যাবে তবে সেখানে কোনো চিনি যোগ করা যাবে না। ভাত কম এবং সেহরিতে শাকসবজি এবং আঁশযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। ডাবের পানি খাওয়া যাবে। চা, কফি পরিহার করতে হবে।

রমজানে ডায়াবেটিস ওষুধ গ্রহণের নিয়ম 

রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পূর্বের ঔষধ রমজানে নতুন করে সাজিয়ে নিতে হবে। কিছু উদাহরণ দেওয়া হল :
 প্রথম কথা রমজানের আগে যারা একবেলা ওষুধ নিতেন রমজানে সেটা চলে যাবে ইফতারিতে।
 দুই বেলা খেলে সকালেরটা ইফতারিতে এবং রাতেরটা সেহরিতে চলে যাবে।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী Sulphonylurea গ্রুপের ঔষধ যেমন Dimerol, Comprid, Secrin এই ধরনের ওষুধ কোন রোগীকে যদি রমজানের সেহরিতে নিতে হয় তাহলে রমজানের পূর্বে যতটুকু পেতো তার অর্ধেক পাবে। তবে ইফতারিতে পেলে পুরোটাই পাবে। Metformin জাতীয় ঔষধ যেমন Comet এর ডোজ কমানোর দরকার নেই তবে রমজানে নতুন করে সাজিয়ে নিতে হবে।
 
যেসব রোগী ইনসুলিন পেতেন তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিনের ডোজ রমজানের জন্য নতুন করে ঠিক করে নিতে হবে। যেমন আগে যদি কোন রোগী শুধু রাতে একটা ইনসুলিন পেতো (লং একটিং) এখন সেটা একই সময় পাবে তবে ৩০% কমিয়ে নিতে হবে। কোন ইনসুলিন যদি আগে কেউ তিন বেলা পেতো তাহলে সকালেরটা একই ডোজে ইফতারিতে, দুপুরের টা বন্ধ এবং রাতেরটা অর্ধেক ডোজে সেহরিতে চলে যাবে। আগে যে ইনসুলিন দুই বেলা পেতো সেটা রমজানে সকালেরটা অপরিবর্তিতভাবে ইফতারিতে চলে যাবে এবং রাতেরটা অর্ধেক হয়ে সেহরিতে চলে যাবে।

রমজানের আগে যেসব ওষুধ অথবা ইনসুলিন খাবার ৩০ মিনিট আগে নেওয়া হতো তাদের জন্য নিয়ম হলো ইফতারিতে নিলে পানি মুখে দিয়ে রোজা ভাঙবে, তারপর ওষুধ অথবা ইনসুলিন নিবে, তারপর হালকা একটি ইফতারি করবে, তারপর মাগরিব নামাজ পড়ে এসে বাকি ইফতারিটা করে ফেলবে। এগুলোর মাঝে কোনো বিরতি দেয়ার দরকার নেই। তবে সেহরিতে ইনসুলিন নিলে সেটা খাবার ৩০ মিনিট আগে নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু ইনসুলিন আছে যেগুলো খাবার একটুখানি আগে অথবা খাবার পরে নিলেও চলে। সেটা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে।

সর্বোপরি ওষুধের নিয়ম ঠিক করার জন্য রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় রোগী গুরুতর শারীরিক জটিলতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।

রোজায় কখন কখন সুগার পরীক্ষা করবেন? 

রোজার মধ্যে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে কয়েকদিন পর পর কমপক্ষে তিন বেলা সুগার পরীক্ষা করতে হবে। যেমন সেহরির আগে, ইফতারির আগে এবং ইফতারের দুই ঘণ্টা পরে। সেহরি এবং ইফতারের আগে সুগারের পরিমাণ ৭ mmol/L এবং ইফতারের দুই ঘণ্টা পরে ১০ mmol/L এর মধ্যে থাকা উচিত।

এছাড়াও রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সুগার পরিমাপের দরকার হতে পারে। মনে রাখতে হবে রক্ত দিয়ে সুগার পরীক্ষা করলে রোজা ভাঙ্গে না।

একজন ডায়াবেটিক রোগী কখন রোজা ভেঙে ফেলতে পারবেন? 

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন এবং মিশরের আলেম সংগঠন একত্রিত হয়ে যে মতামত দিয়েছেন সেটা হলো একজন ডায়াবেটিক রোগী নিম্নলিখিত অবস্থায় রোজা ভেঙ্গে ফেলতে পারবে- 

শরীর অতিরিক্ত খারাপ লাগলে
সুগার পরীক্ষা করে ৩.৯ এর কম অথবা ১৬.৬ এর বেশি পাওয়া গেলে
ডায়াবেটিক গর্ভবতী মা তার বাচ্চার নড়াচড়া কম মনে করলে

এক্ষেত্রে পরবর্তীতে রোগীকে কাজা রোজা আদায় করে নিতে হবে।

তবে দুপুরের পরে অথবা ইফতারির অল্প কিছুক্ষণ সময় বাকি আছে এমন সময় যদি সুগার ১৬.৬ mmol/L এর কিছু বেশি পাওয়া যায় এবং রোগীর সেরকম কোনো উপসর্গ না থাকে তাহলে রোগী ইফতারি পর্যন্ত রোজা চালিয়ে যেতে পারে।

রমজান পরবর্তী পর্যবেক্ষণ

একজন ডাইবেটিক রোগী রমজানের পরে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবার ওষুধ অথবা ইনসুলিন নতুন করে সাজিয়ে নিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

পরামর্শ দাতা: ডা. আমির হামজা, পরিচালক( একাডেমিক); সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স এন্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ; সাবেক আরএমও, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগ, এভারকেয়ার হসপিটাল লি. 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর