বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪, ঢাকা

বাবা হারানোর ব্যথা বুকে উদ্যোক্তা সুস্মিতার পথচলা 

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২৩, ০১:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

বাবা হারানোর ব্যথা বুকে উদ্যোক্তা সুস্মিতার পথচলা 

প্রতিটি মানুষই নিজের মতো করে জীবন সাজান। নানা পরিকল্পনা করেন। তবে জীবন চলে নিজের নিয়মে। কখনো সাজানো পরিকল্পনা মাফিক কাজ হয়। কখনোবা আচমকা ঝড়ে ভেঙে যায় সব। নতুন করে পরিকল্পনা সাজান মানুষ। ফেরদৌসি সুস্মিতার জীবনেও এমন ঝড় আসে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বাবাকে হঠাৎ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন এই তরুণী। নিজের মনকে শক্ত করে মা আর ছোট বোনকে সঙ্গী করে নামেন ব্যবসায়। 

অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘সুস্মিতা'স গ্যালারি’ ‘শিল্পী'স কিচেন’ এর কর্ণধার সুস্মিতা। পোশাক আর খাবারের দুটো প্রতিষ্ঠান সামলাচ্ছেন এই নারী। ঢাকা মেইলের সঙ্গে স্বল্প সময়ের আলাপচারিতায় নিজের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প জানান তিনি। নিজের জীবনের নানা অনুভূতিও প্রকাশ করেন। 


বিজ্ঞাপন


susmita

সুস্মিতার জন্ম ঢাকাতে। ছেলেবেলা কেটেছে শহরের ধুলোবালি গায়ে মেখে। পুতুলখেলা, স্কুল আর বাবা-মায়ের আদরেই কেটেছে দিন। এরপর কলেজ পেরিয়ে নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম শেষ করেন। এরপর নিউজ প্রেজেন্টেশনে প্রশিক্ষণ নেন। ইচ্ছে ছিল পিএইচডি করবেন। তবে সময় আর বাস্তবতার জটিলতার কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। 

বর্তমানে কেবল ব্যবসাই করছেন সুস্মিতা। মায়ের নামে খোলা ‘শিল্পী'স কিচেনে’ পাওয়া যায় ঘরে তৈরি বিভিন্ন খাবার। পোলাও, রেজালা, রোস্ট, শাহী হালিম, ফ্রায়েড রাইস, চিকেন মাসালা কারি, বালাচাও ইত্যাদি পাওয়া যায় এখানে। 

অন্যদিকে, ‘সুস্মিতা'স গ্যালারির’ মূল পণ্য নারীদের পোশাক। শাড়ি, সেলোয়ার কামিজ পাওয়া যায় এখানে। মাঝেমধ্যে কুর্তি নিয়েও কাজ করে সুস্মিতা। 


বিজ্ঞাপন


susmita

ল নিয়ে পড়াশোনা করে অনলাইন ব্যবসায়, কীভাবে এলেন এই সেক্টরে? জানতে চাই তার কাছে। সুস্মিতা বলেন, ‘বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল হয় গান করবো নইলে জাজ হবো। কিন্তু খুব কড়া শাসনে রাখতেন। উচ্চ শিক্ষা ছাড়া কোন চাকরি করা, টিউশন করা কিছুই বাবার পছন্দ ছিল না। বাবার কোনো স্বপ্নই পূরণ করতে পারিনি। অন্য ১০টা মেয়ের মতো মেধা ছিল না।’

‘বাবা সাংবাদিক ছিলেন। এক প্রিয় বান্ধবীর অনুপ্রেরণায় একদিন হুট করেই বলে বসলাম আমি নিউজ প্রেজেন্টার হবো। আব্বু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে রাজি হয়ে গেলেন। শুরু হলো এক অন্যরকম যাত্রা। চাকরিও পেয়ে গেলাম। বাবা এবার মেনে নিলেন। চাকরির পাশাপাশি কিছু করার উদ্দেশ্যে মায়ের দেওয়া নামে পেইজ খুলে রেখেছিলাম ২০১৮ তে। প্রথমে আম্মু হারবাল অয়েল বানিয়ে পেজের মাধ্যমে বেশ কিছু সেল করলেন’- যোগ করেন তিনি। 

susmita

সব যখন সাজানো নিয়মেই আগাতে থাকে তখন হঠাৎ পৃথিবীতে আসে করোনা। চাকরি হারিয়ে গৃহবন্দী হয়ে গেলেন সুস্মিতা। করোনা আর লকডাউনের ধকল যখন কোনোরকমে সামলে উঠছিলেন ঠিক তখন ২০২১ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ করে হারান বাবাকে। প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর পর সুস্মিতার জীবন যেন বড্ড কঠিন হয়ে যায়। 

চাকরির অনেক চেষ্টা করেও মিলছিল না। দিন দিন হতাশ হতে লাগলেন। বাবা চলে যাওয়ায় সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। শুরু হয় আর্থিক টানাপোড়ন। এরই মধ্যে একদিন বন্ধু মাথিন ব্যবসা শুরুর পরামর্শ দেন। দিন দশেক সময় নেন সুস্মিতা। কী করবেন ভাবেন। এরপর সেই বন্ধুদের সাহায্যেই শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। মূলধন যোগাতেও বাকি বন্ধুরা সাহায্য করেছিল। বিশেষত তৃণা, নিকিতা, জুথি, তানিয়া, রুনুর কথা উল্লেখ করে তিনি।  

susmita

সাধারণ পোশাকের পাশাপাশি ইউনিক ডিজাইনের পোশাক আনেন সুস্মিতা। এমন কিছু পোশাক আনেন যা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহজে মিলবে না। ডিজাইন ও রঙ যেন মানসম্মত হয় এবং সবার থেকে আলাদা হয় সেই চেষ্টাও করেন। 

সুস্মিতা বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি পোশাক আমি নিজের জন্যেও এনে পরিধান করে দেখি যে সেটা আমার ক্রেতারা ক্রয় করলে কমফোর্ট ফিল করবে কিনা। তারপর ক্রেতাকে সাজেস্ট করি। এ বিষয়গুলোই হয়তো আমার রেগুলার কাস্টমাররা পছন্দ করে থাকেন।’

ব্যবসা করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। এমনই এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন সুস্মিতা। তিনি বলেন, ‘একদিন একই বিল্ডিং থেকে ৪টা অর্ডার আসে। ডেলিভারি দিতে গেলে ৪ জনই বলেন আমাদের ড্রেস তাদের পছন্দ হয়নি। আমাকে ব্লক করে দিয়েছিল। ডেলিভারি ম্যান কল দিতে দিতে আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। একসঙ্গে ৪ জন না করে দিয়েছে। কখনো এমন হয় না। বেচারা কী ভয়টাই না পেয়েছিল। পরিচিত কেউ হয়তো মজা করেছে।’ 

susmita

সুস্মিতার পরিবার বলতে এখন কেবল মা আর ছোট বোন। ব্যবসায় তাদের দুজনেরই সমর্থন পেয়েছেন তিনি। সুস্মিতা বলেন, ‘আম্মু অনেক সাহায্য করে। আমি মেমো লিখলে সে কাপড়টা ভাজ করে দেয়। আমি প্যাক করলে সে ডেলিভারি ম্যানের হাতে দিয়ে দেয়। এভাবে হাতে হাতে কাজ করে ফেলি আমি আর আম্মু। ছোট বোন মৌমিতা শত ব্যস্ততাতেও প্রোডাক্টে নজর বোলায়। ভালো লাগলে পুরো আমার কাঙ্ক্ষিত দামে সেটা কিনে নেয়। এটাও এক ধরনের সাপোর্ট বলেই মনে করি আমি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? জানতে চাই সুস্মিতার কাছে। তিনি বলেন, ‘একদিন আমি কিছুই পারতাম না। এই বন্ধুরা আমাকে অনেকদূর নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আরও নেবে। ভবিষ্যতে যেন আমিও আমার কিছু বন্ধুকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারি এটাই আমার স্বপ্ন। যারা হয়তো এখন হাল ছেড়েই দিয়েছে যে আর কিছু হবে না তাকে দিয়ে, এমন কিছু বন্ধুকে যেন পথ দেখাতে পারি। এটাই স্বপ্ন।’

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর