মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

ভাগ্যের পরিহাসকে সঙ্গী করে অথির উদ্যোক্তা হওয়া

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৫০ পিএম

শেয়ার করুন:

ভাগ্যের পরিহাসকে সঙ্গী করে অথির উদ্যোক্তা হওয়া

জীবনের বাস্তবতা মাঝেমধ্যেই হার মানায় সিনেমা বা বইয়ের গল্পকে। কঠিন নাটকীয়তা পার করে মানুষ তার পরিচয় গড়ে, জীবন সাজায়। একজন অনলাইন উদ্যোক্তা আলভী রহমান অথি। জীবন বারবার তার থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। তবুও মনের শক্তিতে অদম্য হয়ে এগিয়ে গেছেন এই নারী। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার নানা গল্প, জীবনের নানা অভিজ্ঞতা। 

গাজীপুরের মেয়ে অথি। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। কিছুটা টম বয় ধরনের ছিলেন ছোটবেলায়। শখ ছিল নাচের। স্কুলে নিয়মিত নাচ প্রতিযোগিতায় অংশও নিতেন। ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণীতে ভালো ফল করে নবম শ্রেণীতে ওঠেন। একদিন জানতে পারেন তাকে দেখতে আসবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাত্রপক্ষের সামনে যান অথি। সেদিনই নাটকীয়ভাবে কাবিন হয়ে হয়ে যায় তার। তবে পড়ালেখা চলতে থাকে। 


বিজ্ঞাপন


othi

ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার প্রতি প্রচুর আগ্রহ ছিল অথির। কিন্তু কীভাবে কী করবেন বুঝতেন না। ২০১৮ সালে এইচএসসি পাসের পর পুরনো স্বপ্ন নিয়ে নতুন করে ভাবেন তিনি। অথি বলেন, ‘হঠাৎ করে জমানো তিন হাজার টাকা দিয়ে কিছু জর্জেট ওয়ান পিছ নিয়ে আসলাম। আর একটা পেজ খুললাম। পেজ খুলতে পারা ছাড়া কিছুই জানতাম না। ফোন ভালো না হওয়ায় ভালো ছবিও তুলতে পারছিলাম না। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। পরিবারের সদস্যদের কাছে কেনা দামে জামাগুলো বিক্রি করে ব্যবসার পাঠ চুকিয়ে দিলাম’। 

ব্যবসা করতে না পেরে পড়াশোনা নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন অথি। ফেসবুকে উদ্যোক্তাদের দেখলে মনের ক্ষতটা যেন নাড়াচাড়া দিয়ে উঠত। মনে মনে নানা প্ল্যান সাজাতেন তিনি। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে জানতে পারেন, মা হতে যাচ্ছেন। অনাগত সন্তানের আগমনের আনন্দে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত পাশে রাখলেন। তবে সুখ তার কপালে এলো না। 

othi


বিজ্ঞাপন


অথি বলেন, ‘২০২০ ভয়াবহ করোনার মধ্যে আমি ৮ মাসের গর্ভবতী। হঠাৎ করে জানতে পারি আমার গর্ভের পানি কমে গেছে, সঙ্গে বাচ্চার ওজনও। এত হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করার পরও ওকে বাঁচাতে পারিনি। ফুটফুটে এক মেয়ে হয়েছিল আমার। যদি ওকে দেখতে দেয়নি আমাকে। ছবিতে দেখেছি। এরপর সন্তান হারা এক মায়ের জীবন যেমন কাটে তেমনই কাটতে লাগল।’

মন খারাপের দিনগুলো যেন দীর্ঘ হতে লাগলো। আশেপাশের মানুষ তাকে উপদেশ দিতে লাগলো যেন ডিপ্রেশন থেকে বের হতে কিছু করে। কী করবে ভেবে উঠতে পারছিলেন না অথি। এরপর পরিচিত এক ভাইয়ের কাছে জানতে পারলেন তিনি ব্র্যান্ডের আন্ডার গার্মেন্ট সব আইটেম হোলসেলে বিক্রি করেন। সিদ্ধান্ত নেন অন্তর্বাসের ব্যবসা শুরু করবেন। 

othi

অথি বলেন, ‘ব্যবসা শুরুর জন্য আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। তখন আমার বিয়ের ছোট স্বর্ণের একজোড়া দুল বিক্রি করে দেই। ৭ হাজার টাকা দিয়ে পণ্য কিনি। তখনও ভালো ফোন ছিল না। শ্বশুরের ফোন দিয়ে ছবি তুলে পেজে দিতাম। তবে তেমন সাড়া পেতাম না। পরিচিতদের বলতাম পেজ শেয়ার দিতে। কিন্তু অন্তর্বাসের পেজ হওয়ায় তারা লজ্জা পেত। আশপাশে পরিচিতদের থেকে দুই একজন ক্রেতা পেতাম।’

সুখ যেন অথির শত্রু। নিজের জীবনকে যখন একটু গুছিয়ে নেবেন ভাবছেন তখনই ২০২১ সালের জানুয়ারিতে চোখের সামনে অসুস্থতায় মারা যায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার মানুষ তার নানা। সন্তান, এরপর অতি প্রিয় মানুষ হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। বন্ধ করে দেন ব্যবসা। 

othi

২০২১ আগস্টে নতুন ফোন পেয়ে আবারও নতুন করে ব্যবসায় নামেন এত তরুণী। অথি বলেন, ‘আমি একটা জুয়েলারি গ্রুপে এড ছিলাম। জুয়েলারি কিনতে খুব পছন্দ করতাম। এবার ঠিক করলার জুয়েলারি ব্যবসা করব। আমার ইচ্ছাকে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কারণ এর আগেও দুই বার ব্যবসা শুরু করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, গয়নার ব্যবসাই করবো। 

৫ হাজার টাকা পুঁজিতে শুরু করলে ব্যবসা। ২০১৮ সালে খোলা পেজ পরিবর্তন করে নাম দিলেন, ‘সিক্রেট অফ কুইন’ (Secret Of Queen)। একটি গ্রুপ খুললেন ‘কুইন'স অফ জুয়েলারি’ (Queen Of Jewelry) নামে। ঘরের মানুষদের কাছে ব্যবসার কথা গোপন রাখলেন। খুব একটা সাড়া এবারও মিললেন না। আবারও আশাহত হলেন। হার মানতে শুরু করলেন। 

othi

কেনা গয়নাগুলো অল্প লাভে ছেড়ে দেওয়ার প্ল্যান করেন অথি। এবার আস্তে আস্তে অর্ডার আসা শুরু হয়। জমানো আরও ৫ হাজার টাকা দিয়ে আবার পণ্য কেনেন। এভাবেই তার ব্যবসাজীবনে পথচলা শুরু। 

আল্লাহ যেন বারবার তার পরীক্ষা নিতেই থাকেন। এক মাস না যেতেই ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড পেটব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। জানতে পারেন একটোপিক প্রেগনেন্সি হয়েছে। মানে বাচ্চা টিউবে ডুকে এবং টিউবটি ফেটে যায়। ডাক্তার জানান সিজার করাতে হবে এবং ৪/৫ ব্যাগ রক্ত লাগবে। এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল বদলে, রক্ত ম্যানেজ করে সিজার হলো, কিন্তু সন্তানকে এবারও বাঁচাতে পারলেন না। 

othi

এরমধ্যেই অথির সিজারের সেলাইয়ে ইনফেকশন দেখা দেয়। ১৭ দিন ঢাকা মেডিকেল থাকতে হয়। শেষ পর্যায়ে হাসপাতাল থেকে অর্ডার নেওয়া শুরু করেন। বাড়ি ফিরে নিজেকে সুস্থ রাখতে ব্যবসা চালিয়ে যান তিনি। 

অথি বলেন, এই ব্যবসাটা না থাকলে বাঁচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলতাম। আমার স্বামী আর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বিপদে আমার পাশে ছিলেন মানসিকভাবে। অনেক মানুষের সাড়া পাই ব্যবসা করতে এসে। অনেক ক্রেতাই না চাইতেই রিভিউ দিত। একজন উদ্যোক্তার জন্য যা অনেক বেশি প্রয়োজন মনে করি। 

othi

২০২২ সালে আরও দুটি এক্সিডেন্ট হয় অথির। প্রেশার কুকার বাস্ট হয়ে দুই হাত ভয়ংকরভাবে পুড়ে যায়। তার কিছুদিন পর জানতে পারেন পিওথলিতে পাথর। কিছুদিন আগে যার অপারেশন করা হয়েছে। নিজের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে পাশে রেখে ব্যবসা চালিয়ে যান অথি। এক্ষেত্রে তার ননদ তাকে বেশ সাহায্য করে। 

৫ হাজার টাকা পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করলেও বর্তমানে মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন অথি। সংসার টুকটাক খরচ চালাতে পারেন নিজের অর্থে। নিজেকে সৎ ও আদর্শ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে চান অথি। নিজের পরিবার এবং রাস্তার অসহায় মানুষের জন্য কিছু হলেও করার স্বপ্ন দেখেন। 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর