শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পিতৃ‌ভিটায় ফেরার আকুতি

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২২, ১১:২৫ এএম

শেয়ার করুন:

পিতৃ‌ভিটায় ফেরার আকুতি

‘তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা/ বাংলা ভেঙে ভাগ করো!/ তার বেলা?’—কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘খুকু ও খোকা’ কবিতার এই পঙক্তিমালা মনের কোথায় যেন ধাক্কা দেয়। যে বাংলাকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করি তার আবার ভাগ হয়? মাতৃভূমিকে ভাঙা যায়? শেকড় কে কি উপড়ে ফেলা অতই সোজা?  

১৯৪৭ সাল। বছরটি অনেকের জন্যই বীভৎস এক স্মৃতির নাম। এপ্রিল মাসেও কেউ বোঝেনি, আগস্টে অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগতে হবে। বোঝেনি ভাগ হয়ে যাবে দেশ। এপারের মানুষ চলে যাবে ওপারে, আর ওপারের মানুষ আসবে এপারে। 


বিজ্ঞাপন


deshvag

১৯৪৭ এর ভারত বিভাজন বা দেশভাগ হলো ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন দেশে বিভক্ত করার ঘটনা। এই বিভাজনটি ধর্মীয় ভিত্তিতে ১ থেকে ২ কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে। দেশভাগের মাস তিনেক আগেও খুলনা বা মুর্শিদাবাদের মানুষ বিভ্রান্ত হননি নিজেদের পরিচয় নিয়ে। ভারত না পাকিস্তান? কোন দেশের পতাকা ওড়াবে তারা? 

শেকড়, জন্মভূমি, সংস্কৃতি, আনন্দ-বেদনা কোনোকিছুর কথা না ভেবেই ভারতকে দুই ভাগ করা হয়। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় অসংখ্য মানুষের ঠিকানা। অনেকের নতুন পরিচয় হয় ‘উদ্বাস্তু’। সাত পুরুষের ভিটা, পরম স্নেহের মাঠ-ঘাট, নদী, শৈশব, কৈশোর, স্মৃতি, সংগ্রাম সব পেছনে ফেলে ভিন্ন দেশে যেতে হয় অগণিত মানুষকে। কেবল ধর্ম পরিচয়কে সঙ্গী করে ফেলে যায় স্মৃতির ভূমি, প্রিয়জনের কবর কিংবা শ্মশান। অনেকের জায়গা হয় শরণার্থী শিবিরে। 

deshvag


বিজ্ঞাপন


দেশ ঠিকই ভাগ হলো। অভিন্ন ভারত থেকে কেউ হলো ভারতের, কেউ পাকিস্তানের। তবু প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার বুকে বয়ে চলে বেদনা সুর। পূর্বপুরুষের ভিটার স্মৃতি উঁকি দেয় কষ্টের কূপ থেকে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, ‘আহা, নিজের বাপের ভিটায় যদি ফিরতে পারতাম।’ 

রাজনৈতিক কিংবা ভৌগলিক কারণে ভাগ হয় দেশ। কিন্তু স্মৃতি, অনুভূতি, প্রজন্মের বন্ধন ভাগ হবার নয়। দেশভাগের ছাপ মানুষের মনে তিক্ত এক অভিমানের জন্ম দেয়। গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায় ছিলেন বরিশালের। দেশ ভাগ হওয়ায় তিনি হয়ে গেলেন ভারতের। তাইতো গানের ভাষায় গেয়েছেন, ‘দুজনে বাঙালি ছিলাম/ দেখরে কি কাণ্ডখান.../ তুমি এখন বাংলাদেশি/ আমারে কও ইন্ডিয়ান’। 

deshvag

একই অনুভূতি প্রকাশ করে ঔপন্যাসিক অমর মিত্রের। অভিন্ন বাংলার স্বপ্ন চোখে এঁকে তিনি বলেন, ‘এমন একটা যদি রেলগাড়ি হতো যে রেলগাড়িতে চেপে ঢাকা থেকে যাত্রা করে খুলনা কলকাতা হয়ে দিল্লি লাহোর পৌঁছে যেতা’। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি আলোচনায় আসে ‘বঙ্গ ভিটা’ নামের একটি পেজ। দেশভাগের সময় বাংলাদেশ ছেড়ে যাদের ভারতে বসত গড়তে হয়েছিল তারাই এই পেজটির মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। আবার ভারত ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন এমন অনেকেও নিজেদের কথা লেখেন। স্মৃতি টেনে স্মরণ করেন জন্মভূমিকে। উদ্দেশ্য একটাই। কোনো না কোনো সূত্র ধরে যদি ফেরা যায় পিতৃভূমিতে। যদি একবার খোঁজ মেলে শেকড়ের। 

deshvag

দাদু, ঠাকুমা, বাবা ও জেঠুর ছবি প্রকাশ করে ভারতের কলকাতা থেকে অনিন্দিতা মিত্র লেখেন, ‘আমার দাদুর বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার দূতশোর ইটভাটা ও ফুটবল ফিল্ডের পাশেই। আমার বাবা অহীন্দ্র মিত্র ভূমিকা রেখেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। বাবার ডাক নাম লুলু। আমার দাদুর নাম ছিল ডা: অমুল্য মিত্র। লোকে জোটো ডাক্তার বলে ডাকত। দাদু ওদেশে থাকতেই মারা যান। আমি আমার দাদুর বাড়ি ও এলাকার ছবি দেখতে চাই। যদি সম্ভব হয় আমার শেকড় ছুঁতে সাহায্য করবেন।’

ভারত থেকে মলয় শংকর ভট্টাচার্য নামের একজন লেখেন, ‘বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বন্ধুদের সহযোগিতা চাইছি। আমি যেতে চাইছি আমার পূর্বপুরুষের গ্রামে। গ্রাম মঙ্গল পাড়া, পোস্ট অফিস মঙ্গল পাড়া, থানা পুটিয়া, জেলা রাজশাহী। আমার ঠাকুরদা সারদা শংকর ভট্টাচার্য, ১৯৩৪ সালে মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৪৪ বছর। আমার বাবা বিমল শঙ্কর ভট্টাচার্য, ১৯৩৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক হন। সম্ভবত ১৯৩৭ সালে, দুটি ছোট ভাই, মা আর পিসি মাকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। আমার মামার বাড়ি নওগাঁ। স্বাধীনতার পরে শেষবার নওগাঁ যাওয়া হয়েছিল সম্ভবত ১৯৫৪ সালে। আমার একমাত্র পিসির বিয়ে হয়েছিল নাটোরে চক্রবর্তী পরিবারে। আমি ২০১৭ সালে রাজশাহী গিয়েছিলাম, রাজশাহী কলেজ ঘুরে ফিরে দেখেছিলাম, কিন্তু মঙ্গল পাড়া পৌঁছতে পারিনি, সঠিক ঠিকানা ছিল না বলে। ডিসেম্বরে শেষ সপ্তাহে, আমি আমার দিদি, মঙ্গল পাড়া গ্রামে একবার পৌঁছাতে চাই। আমার বাবা এবং এক কাকা, তাহেরপুর হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। যতদূর স্মরণে আসছে, আমার পিতামহ তাহেরপুর রাজবাড়ির কর্মচারী ছিলেন। আমাদের আদি পদবী ছিল মৈত্র। আমার বাবা বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ১০৭ বছর।’

deshvag

তার এই লেখা পড়ে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে জানান তিনি। এই দেশে আমন্ত্রণ জানান তাকে। এমনই অনেক মানুষের সুখের অনুভূতি হতে কাজ করে যাচ্ছে পেজটি। 

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর