সময়টা শেষ হেমন্তের কোনোএক পড়ন্ত দুপুর বেলা। নাম না জানা কোনো এক দ্বীপের উত্তরমুখী কোনো বালুকাবেলায় তখন দিনের প্রথম জোয়ার আসি আসি করছে। সাগরের উন্মত্ত ঢেউগুলো বিশাল এক জানোয়ারের মতো তেড়েফুঁড়ে ছুটে আসছে বালুকাবেলার দিকে। যেন পায়ের তলায় পিষে ফেলতে চাইছে সামনের সমস্ত কিছু। তবে আসতে আসতে দু-তিনটে পানিতে ডুবন্ত চরগুলোতে বাধা পেয়ে মিশে গিয়ে পরিণত হচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা ঢেউয়ে। পরে এসে আস্তে করে চুমু দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপের পায়ে।
বালুকাবেলার ধার ঘেঁষে লম্বা ঘাসের বন, এক মানুষ লম্বা। মিলেমিশে একে-অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৈরি করে রেখেছে দুর্ভেদ্য দুর্গ। সেই দুর্ভেদ্য দুর্গগুলো উত্তর-পশ্চিমমুখী বাতাসে এলিয়ে এলিয়ে সাজিয়ে নিচ্ছে নিজেদের ভেতর। সাগর আর ঘাসবন, মাঝে বিশাল এক বালুর রাজ্য। এই বালুর রাজ্যে রাজা হলো হাজার হাজার সাদা কাঁকড়া। ছোট, বড়, মেঝ, সেঝ- নানান আকারের সাদা কাঁকড়া। সারাদিন তাদের একটাই কাজ-নিজেদের ভেতর হুটোপুটি করে বেড়ানো, আর বিশাল আকারের একটা মদনটাকের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসা।
বিজ্ঞাপন
আর সব শান্ত। শান্তই বলা চলে আরকি। শুধু তীব্র বাতাসে মাঝে মাঝে বালুকাবেলার ছোট ধূলিকণাগুলোর এদিক ওদিক ছুটে যাওয়া বাদে। এই একমুখী ধূলিঝড় মাঝে মাঝে চোখে একটা ধাঁধার সৃষ্টি করে। কেমন যেন মনে হতে থাকে বালুকাবেলার ওপর একটা কুয়াশার আস্তরণ। আর কিছু না।
নাহ, ভুল বললাম। আরেকটা জিনিস আছে। ঠিক জিনিস না, আরেকজন। একজন মানুষ। সে এই কাঁকড়ার রাজ্যের কেউ না। সে আসে, মাছ ধরতে। সে আসে, কিছুটা সময় কাটাতে। সে আসে, এই থেমে থেমে বয়ে যাওয়া বালুঝড়ের ভেতর পা ডুবিয়ে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে। আজ ও সে এসেছে। সাথে করে নিয়ে তার দুটি দশ ফুটি মাছ ধরার ছিপ, একটা ভাজ করা চেয়ার, দুটি ছিপদানি, ব্যাগ ভর্তি মাছ ধরার সরঞ্জাম, আর একটা ঢাকনা জোড়া বাক্স। ওই বাক্সে ছোট ছোট মাছ, জীবন্ত।
এই ছোট ছোট মাছ দিয়ে ধরা হয় মাঝারি মাছ। আর ওই মাঝারি মাছ দিয়ে ধরা হয় বড় মাছ। আবার ওই বড় মাছ দিয়ে ধরা হয় আরও বড় মাছ। তা দিয়ে আরও বড় মাছ ধরা হয়... তিমি মাছ? ধুর তা কীভাবে হয়। তিমি মাছ কি কেউ এইভাবে ধরে, জানি না। ধরে বোধয়।
মানুষটা কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্স থেকে একটা ছোট মাছ ধরার চেষ্টা করে। ছোট মাছগুলো মানুষটার হাত ফাঁকি দিয়ে পানি ভর্তি বাক্সময় এঁকেবেঁকে চলতে থাকে। একটা মাছ আবার অতি উৎসাহী হয়ে লাফিয়ে বের হয়ে যায় বাক্স থেকে। বের হয়েই বালুতে মেখে গিয়ে থেমে যায় তার দুরন্তপনা। মানুষটা ওই মাছটাই তুলে নিয়ে অনেক সাবধানে গেঁথে দেয় তার ছিপের সাথে বাঁধা দুই সাইজের হুকের সাথে। হুক এ মাছটা গেঁথে ঠিক করে নেয় তার আর সুতার মাঝামাঝি পিরামিড আকারের ভারটাকে। এরপর কাঁপাকাঁপা হাতেই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ছুঁড়ে দেয় মাছসহ হুক আর ভার।
বিজ্ঞাপন
সাগরের লবণ জড়ানো তীব্র বাতাস আলাদা করে শীষ কেটে ছুটে যায়। যেন কোনো এক মহাশূন্যের অন্তরীক্ষ তার গন্তব্য। কিন্তু বেঁধে রাখা সুতই যেন তার রাশ। রাশে টান খেয়ে হারিয়ে যায় নীল সাগরের বুকে, কোনো এক মাঝারি মাছের খোঁজে।
বসে থাকা মানুষটি তার বয়সের ভারে ন্যুয়ে ঘাড়টাকে নিচু করে অপেক্ষা করতে থাকে কোনো এক অজানা মাঝারি মাছের জন্য। গোড়ালি পর্যন্ত বালিতে দেবে যাওয়া পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বালির সাথে খেলা করতে করতে। মানুষটা বৃদ্ধ, বয়েস সত্তুর কি পঁচাত্তুর। মাথায় খয়েরি রঙের একটি হ্যাট। গায়ে বর্ষাতি। লাল কালো মিশানো বর্ষাতি। দাঁড়ি আর চুলের জঙ্গলে প্রায় পুরোপুরি ঢেকে যাওয়া মুখ, কিন্তু চোখগুলো স্পষ্ট, উজ্জ্বল।
সেই উজ্জ্বল চোখ মেলে পায়ের আশপাশ দিয়ে আলগোছে ঘুরে বেড়ানো একটা মাঝারি সাইজের সাদা কাঁকড়াকে দেখছে। কাঁকড়াটা বালুর ওপর দিয়ে আল্পনা কেটে তার ইতিউতি চোখ মেলে, একবার সামনে একবার পিছনে করছে। কেমন জানি একটা নেশার মতো। মানুষটা অনেকটা ঘোরের ভেতর চলে যাচ্ছে। সেই ঘোর ধরানো নেশা মুহূর্তেই কেটে যায় রিলের প্রচণ্ড কড়কড় শব্দে, মাছ ধরেছে।
মানুষটার উজ্জ্বল চোখ আর উজ্জ্বল হয়। খানিকটা লাফ দেওয়ার মতো করেই লাফিয়ে উঠে ধরে ফেলে ছিপটা। প্রচণ্ড গতিতে ঘোরাতে থাকে রিলের হাতল। মাছ ধরেছে, কোনো একটা নাম না জানা মাঝারি মাছ।
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী
বিইউ/আইএইচ

