প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেক ভ্যালি। রাঙামাটি জেলার বাগাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক বাংলাদেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা চারপাশ। সকালে সূর্য ওঠার আগে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকে মেঘ। দেখে মনে হয় মেঘ আর পাহাড়ের মিতালি এখানে। পাহাড়প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। মেঘ প্রকৃতির মিতালিতে নিজেকে যে কেউ হারিয়ে ফেলে। আর ঘুরতে যাওয়ার জন্য সবার কাছে এটি একটি অন্যতম পছন্দের স্থান। এই প্রতিবেদনে সাজেক ভ্যালিতে যাওয়া-আসা থাকা-খাওয়ার তথ্য পাবেন।
আয়তন
বিজ্ঞাপন
বাগাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। ভারতের ত্রিপুরা-মিজোরাম সাজেকের সীমান্তবর্তী এলাকা। সমুদৃপৃষ্ঠ থেকে সাজেকের উচ্চতা ১ হাজার ৮০০ ফুট। খাগড়াছড়ি দীঘিনালা থেকে সাজেকের দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ি থেকে যাতায়াত অনেক সুবিধাজনক হওয়ায় ভ্রমণপিপাসুরা দীঘিনালা থেকেই সাজেক যেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
সাজেক যাবেন যেভাবে
দেশের যেকোনো স্থান থেকে প্রথমে আপনাকে আসতে হবে খাগড়াছড়িতে। খাগড়াছড়ির প্রাণকেন্দ্র শাপলা চত্বর গাড়ি থেকে নামবেন। তারপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল। নাশতা করার জন্য রয়েছে রেস্টুরেন্ট। এরপর চত্বরের পাশেই রয়েছে সাজেক যাওয়ার জন্য গাড়ির কাউন্টার। সেখান থেকে রিজার্ভ দেওয়া হয় সাজেকগামী চাঁদের গাড়ি, পিকআপ, মাহেন্দ্রা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন গাড়ি।
সাজেক যাওয়ার ভাড়া
বিজ্ঞাপন
সাজেক যাওয়া গাড়িগুলো সিএনজি থেকে শুরু করে পিকআপ পর্যন্ত রিজার্ভ করে নিতে পারবেন। সাজেক এক রাত যাপন চাঁদের গাড়ি ৬ হাজার ৬০০ টাকা। খাগড়াছড়িসহ ঘুরলে ৮ হাজার ১০০ টাকা। পিকআপে গিয়ে রাত্রিযাপন ৭ হাজার ৭০০ টাকা। খাগড়াছড়িসহ ৯ হাজার ৭০০ টাকা। যদি দুই-তিনজন আসেন, তাহলে রয়েছে সিএনজির কাউন্টার। এক রাত থাকাসহ সিএনজি হলে ৪ হাজার ৫০০ টাকায় পাওয়া যায়।
নিতে হবে অনুমতি
সব প্রস্তুতি শেষে এবার সাজেকের উদ্দেশে রওনা দিয়ে প্রথমে আপনাকে যেতে হবে বাঘাইহাট আর্মি চেকপোস্টের সামনে। গাড়ির চালকসহ সেখানে সবার তথ্য দিয়ে টোকেন নিতে হবে। এরপর শুরু হবে সেখান থেকে সকাল ১০টায় এসকট। এসকটের গাড়ির পেছনে যেতে হবে মাচালং আর্মি চেকপোস্টে। সেখান থেকে পরিবর্তন হবে এসকটের গাড়ি। সেই গাড়ির পেছনে যেতে হবে সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত।
কাটতে হবে টিকিট
ভেতরে ঢুকতেই রয়েছে প্রবেশ ফি টিকিট কাউন্টার। টিকিট নিয়ে প্রবেশ করতে হবে ভেতরে। প্রতিজন পর্যটকের জন্য ২০ টাকা, চাঁদের গাড়ির জন্য ১০০ টাকা এবং মোটরসাইকেল হলে ৫০ টাকার টিকিট নিয়ে প্রবেশ করতে হয় ভেতরে। বের হওয়ার সময় সেই টিকিট ফিরিয়ে দিতে হয় সেখানে।
সাজেকে যেখানে রাত্রি যাপন করবেন
প্রকৃতিঘেরা সাজেক ভ্যালিতে রয়েছে নানা রকম রিসোর্ট। কাঠের, বাঁশের, টিনের ও পাকা অসংখ্য কটেজ। এর মধ্যে পাকা কটেজ রয়েছে উন্নত মানের। এগুলো এক রাতের ভাড়া ৬ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। কাঠের তৈরি কটেজে রয়েছে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকায়। বাঁশের তৈরি কটেজ রয়েছে ২ থেকে ৪ হাজার টাকায়। সব পর্যটক তাদের চাহিদা অনুসারে রাত যাপন করতে পারবেন। নিজেদের স্বাধীনতার মধ্যে থাকতে পারে রিসোর্টে। এই রিসোর্টগুলো থেকে দেখা যায় প্রকৃতিঘেরা নয়নাভিরাম পাহাড়। সেসব পাহাড়ে ভোর হলেই দেখা মেলে মেঘের আনাঘোনা। পর্যটকরা এমন মনকাড়া দৃশ্যের জন্যই অপেক্ষা করে থাকেন।
সাজেকে কী খাবেন?
সাজেকে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট। সবাই পছন্দ অনুসারে যেকোনো হোটেলে খেতে পারবে। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু খাওয়ার ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না সেখানে। তবে খেতে হলে আগে থেকেই অর্ডার করতে হয় চাহিদা অনুসারে। সকালের নাশতায় ভুনা খিচুড়ি বা পরোটা সঙ্গে ডিমভাজি বা ডাল খেতে পারেন। নাশতা শেষে পান করুন চা। দুপুরে পাবেন দেশি মুরগি, মিক্সড সবজি, আলুভর্তা, ডাল, ভাতসহ একটি প্যাকেজ।
অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে হলে আগে থেকেই রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অর্ডার করে রাখতে হবে চাহিদা অনুসারে। রাতে থাকে বারবিকিউ, পরোটা, সস, সালাদ, কোক অথবা ব্যাম্বু চিকেন, মিক্সড সবজি, আলুভর্তা, ডাল, ভাত ও ব্যাম্বু বিরিয়ানি। তবে সাজেকে খাওয়ার জন্য সবকিছুই আগে থেকে অর্ডার দিতে হয়। এছাড়া কোনো কিছুই তৈরি করা পাওয়া যায় না।
খাবারের দাম
সকালে খাবার প্যাকেজ অনুসারে ৮০ থেকে ১২০ টাকায় প্রতিজনের খাবার, দুপুরে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় প্যাকেজ, রাতের খাবারে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় পাওয়া যায়। তবে বাড়তি খাবার প্যাকেজের সঙ্গে নিতে চাইলে নেওয়া সম্ভব। টাকা দিতে হবে অর্ডার করা সব খাবারের। এ ছাড়া ভেম্বো চিকেন প্রতিটি দিয়ে খেতে পারে চারজন। যার মূল্য ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা। ব্যাম্বু বিরিয়ানি একটি দিয়ে খেতে পারে দুজন। যার মূল্য ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
কোথায় বেড়াবেন?
প্রথমে সাজেক পৌঁছে রিসোর্টে উঠবেন। সেখানে নিজের সব জিনিসপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্টে খাবেন। এরপর চারটার দিকে যাবেন সাজেকের সবচেয়ে উঁচু কংলাক পাহাড়ে। যেখান থেকে দেখা মেলে সাজেকের পুরো চিত্র। আর মন ভরে দেখতে পারবেন সূর্যাস্ত।
এবার কংলাক থেকে ফিরে আসবেন হেলিপ্যাড। সেখানে হয় সব পর্যটকের মিলন মেলা। সবাই মিলে আনন্দে মেতে ওঠে এই মাঠে। অনেক পরিচিত লোকের দেখা মেলে হেলিপ্যাডে। তার চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান। সূর্যাস্তের পর সবাই সেখানেই নাশতা সেরে ফেলুন।
হেলিপ্যাড ঘোরা শেষে সবাই রিসোর্টে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার বের হয় রাতের দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। একটু ঘোরাঘুরি শেষে রাতের বারবিকিউ পার্টিতে গানবাজনা করে আনন্দে মেতে উঠুন। ডিনার সেরে আবার ঘুরতে বের হতে পারেন। অনেকে বিভিন্ন জায়গায় বসে আড্ডা দেয় মাঝ রাত পর্যন্ত। তারপর কটেজে গিয়ে ঘুমানোর পালা।
সকালে সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে আপনার চোখে দেখা মিলবে চারপাশ জুড়ে ঘন মেঘ। এই মেঘের বুক থেকে ভেসে আসে লাল বর্ণের সূর্য। মনে হয় যেন মেঘের ভেতর থেকে সূর্য হাসি দিচ্ছে। এমন দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন পুরো সাজেকে। সেখানে রয়েছে সকালে ঘোরার জন্য ঝাড় ভজ পার্ক ও স্টোন গার্ডেন নামের দুটি জায়গা। এখানে রয়েছে বসার স্থান ও ছবি তোলার অনেক প্রাকৃতিক উপকরণ পাবেন।
ফেরার পালা
প্রকৃতি উপভোগ শেষ করে রিসোর্টে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা সারবেন। তারপর ফেরার পালা সাজেক ভ্যালি থেকে। আসতে হবে খাগড়াছড়ি শহরে। এখানে রয়েছে অনেক আদিবাসী রেস্টুরেন্ট। সেখান থেকে আদিবাসীদের নানা রকম বাহারি রান্না করা খাবার খেতে পারবেন নিজের পছন্দ অনুসারে। দুপুরের খাবার শেষে ঘুরতে পারবেন আলুটিলা, রিছাং ঝরনা, হর্টিকালচার পার্ক ঘুরে সন্ধ্যা নামলে বাজারে এসে বিভিন্ন বার্মিজ মার্কেট। তারপর রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাবার শেষে আপনার গন্তব্য পৌঁছানোর পালা। এ জন্য রয়েছে নানা রকমের গাড়ি।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
সাজেক গিয়ে উপভোগ করতে পারবেন সাজেক রুইলুই পাড়ার দৃশ্য, কংলাক পাহাড়ের মনোরম প্রকৃতি, ঝারভোজ পার্ক, স্টোন গার্ডেন পার্ক। সকালে চারপাশে মেঘের খেলা। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়। এছাড়া সাজেক এলে দেখতে পারবেন খাগড়াছড়ির পাহাড়ে প্রকৃতি ভরা আলুটিলা, রিসাং ঝর্না, হর্টিকালচার পার্ক, মায়াবিনী লেক, অরণ্য কুটিরসহ বিভন্ন পর্যটনকেন্দ্র। তবে সব দৃশ্য ঘুরে দেখতে হলে অবশ্যই আপনাকে সাজেকে এক রাত এবং খাগড়াছড়ি এক রাত যাপন করতে হবে। তাহলে নিজের মনমতো ঘুরে সব দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
প্রস্তুতি ও পরামর্শ
সাজেকে যে বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে:
* জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখবেন।
* প্রয়োজনের বাইরে পানি নষ্ট করা যাবে না।
* সেনা ক্যাম্পের সামনে ও ক্যাম্পের ভেতরের ছবি তোলা নিষেধ।
* আদিবাসীদের ছবি তুলতে অনুমতি নিতে হবে।
* পাহাড়ে ব্যহারের জন্য রবি, এয়ারটেল, টেলিটক সিম নিয়ে যাওয়া।
* সাজেক যেতে অবশ্যই নিজে দেখে গাড়ি ভাড়া করবেন।
* দুইদিন আগে থেকে হোটেল-কটেজ ভাড়ার বিষয়ে যোগাযোগ করবেন।
* যারা মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে আসেন, তারা নিয়ম মেনে বাইক চালান।
* পাহাড়ি রাস্তায় ওভারটেক এড়িয়ে চলুন।
* যারা নিজের গাড়ি নিয়ে আসবেন, অবশ্যই অভিজ্ঞ চালক নিয়ে আসবেন।
* গাড়ির সবকিছু চেক করে নিয়ে আসবেন। যাতে পাহাড়ে এসে আটকে না পড়েন
* পাহাড়ি এলাকায় নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া কোথাও গাড়ি মেরামত করার সুযোগ নেই
ডব্লিউএইচ/এজেড