বছর ঘুরে আবার এসে গেল পূজা। পূজোর জন্য সেই যে সারাবছরের অপেক্ষা, সে অপেক্ষার প্রহর বুঝি ফুরোল। পূজার আনন্দ হতো ছোটবেলায়। তখন তো না চাইতেই পূজোর ছুটি মিলে যেতো, হই হই করে ৫/৬টা দিন কাটানোর জন্য সময় পেয়ে যেতাম আপনাতেই। বড় হবার পর, এখন আগে-পিছে কতকিছু ভেবে কদিনের ছুটি চেয়ে নিতে হয়. তারপর যেয়ে পূজো শুরুর আলাপ!
সেই যে আমার ছোটবেলার পূজোর গপ্পো। কখনো গ্রামের বাড়িতে, কখনো বা ঢাকা শহরে কাটানো। গ্রামের বাড়ি যেবার পূজা করতে যেতাম, সেবার ঢাকা হতেই পূজোর যাবতীয় কেনাকাটা সারা হতো, মায়ের সঙ্গে মার্কেট ঘুরে প্রিয় জামা, জুতা কিনে তবেই বাড়ি ফেরা। সেই জামা আবার পূজার দিনের আগে লোককে দেখানো চলবে না!
বিজ্ঞাপন
বাড়িতে যাবার পথেই পূজাবাড়ি পড়তো, দূর হতেই সেই পূজাবাড়ির ঝলমলে সাজসজ্জা দেখে ছোট্ট মনের আনন্দ হতো দ্বিগুণ। এরপর পূজোর কয়টাদিন বাড়ি থেকেই শুনতে পাওয়া ঢাকের আওয়াজ, বাতাসে পূজোর ধূপ-ধুনোর গন্ধ, রাতেরবেলা সদ্য ফোঁটা শিউলিফুলের ম ম করা সুঘ্রাণ কিংবা বড় স্পীকারে দিনভর চলা ঝাকানাকা গানের বিট, শুনতে পেলেই ভৌ-দৌড় দিতাম মণ্ডপে!
মণ্ডপের বাইরে সেখানে বসতো মনোহরি আইটেম আর খুচরা খাবারের বাহারি পসরা, হাতে পাঁচ টাকা থাকা মানেই সেই মজা! এই শন-পাপড়ি খাওয়া তো ওই আচার খাওয়া, কখনো লজেন্স, কখনো ঝালমুড়ি আবার কখনো চিপস! নিজের কাছে টাকা নেই তো আশেপাশের দাদা-ভাইদের কাছে আবদার। আবার যখন মায়ের সাথে মণ্ডপে আসতাম,তখন বায়না থাকত এটা ওটা গয়না কিংবা খেলনা কেনার!
বিজ্ঞাপন
পূজোর ঢাকের সাথে ধুনুচি নাচ দেখা, অষ্টমী-নবমীর রাত করে হওয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এসব ছিল রীতিমতো চরম উৎসাহের ব্যাপার। আবার আত্মীয় স্বজনের দেওয়া নতুন জামা জুতা পড়ে বড় দিদি-জেঠিমাদের সঙ্গে এদিক সেদিক পূজা দেখতে যাওয়াতও ছিল বাধ্যতামূলক কাজ। ফেরার সময় ক্লান্ত শরীর আর চলতো না, কিন্তু মনে ভারী আনন্দ হতো!
দেখতে দেখতে পূজার দিনগুলি শেষ হয়ে গেলে দশমীতে মায়ের বিসর্জন শেষে আমাদের ও ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে ঢাকা ফেরার পর্ব চলত। সেইসময়টায় মন খারাপির সঙ্গে কিছু তুলনা করা যেতো না। তবে আশা ছিল একটাই, 'আসছে বছর আবার হবে!'
কোনো কোনো বছর ঢাকাতেও পূজা দেখা হতো। সেই কয়টাদিন একদম বইখাতা বন্ধ। মায়ের কাছে বলাই থাকতো, পূজা শেষ হবার আগে পড়তে বলা যাবে না! তারপর মা-বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে করে ঢাকায় কয়েকটা মণ্ডপে পূজা দেখতে যাওয়া। ঢাকার মণ্ডপগুলোতে রাতে যে দারুণ সব আলোকসজ্জা হতো, তা দেখতে দেখতে ঘুরতে যাওয়ার সময়গুলো মনে হতো ওখানেই থেমে থাকুক!
কিন্তু দিন এমন থাকে না। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশুনা বাড়তে থাকে, মেডিকেলে আসার পর কোনোরকমে পাঁচদিন ছুটি ম্যানেজ করাটাও হয়ে গেলো কঠিন! আর আগেপরে সেই আনন্দ তো কমলোই। শরীর মনে স্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা বিচারে আনন্দের মাত্রাটাও কমিয়ে আনতে হয় একসময়।
এরপর তো কর্মজীবনে প্রবেশ, আর ডাক্তার হবার পর থেকে দেখেছি পূজার ছুটির চেয়েও আনন্দ এটাতেই বেশি যে অন্তত একটা ছুটি মিলছে! কয়টাদিন একটু রেস্ট করা যাবে এবার! তাও হাসপাতাল, চেম্বার, রোগীর ফোন তো থাকেই!
বড় হয়ে যাবার পর পূজোর আনন্দ বোধহয় এটাই যে পরিবারের সাথে একান্তে দুটোদিন বেশ করে কাটানো যাবে কিংবা নিজের জন্য নতুন জামা কেনার জন্য মা-বাবার জন্য নিজের টাকায় কিছু হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারটাই।
কেননা এই সময়টুকুতে মা দুর্গা তার ভক্তদের জন্য ফিরে আসেন মর্ত্যে, তেমনি আমার মতোন অনেক মেয়েরা ফিরে আসে নিজঘরে। ছোটবেলা হোক কিংবা বড়বেলা, পূজার সময়টুকু তাই সবসময়ই স্পেশাল।
লেখক: মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, লাখাই, হবিগঞ্জ
এনএম