শুকনো পাতার শব্দকে মর্মর বলা হয়। বড্ড ভঙ্গুর সেগুলো। হাতে নিয়ে একটু জোরে চাপ দিলেই ভেঙে পড়ে। কিন্তু যদি শোনেন এই পাতার গায়েই সুঁই-সুতা দিয়ে কেউ কারুকাজ করেছে? আপনার আমার কাছে প্রায় অসম্ভব মনে হলেও কাজী মাহফুজার কাছে তা সম্ভব। সদ্য স্নাতক শেষ করা এই তরুণী গাছের পাতাকে বানিয়েছে সুঁইয়ের ফোড় তোলার মাধ্যম। কখনো বা পাতাকে ক্যানভাস বানিয়ে এঁকেছে মনের মতো ছবি।
মাহফুজার জন্ম ১৯৯৮ সালে। ছেলেবেলায় খুব চঞ্চল আর ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। এখনও তাই আছেন। স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করে মাহফুজা হেসে বলেন, ‘এখনো মনে আছে ক্লাস ফাইভে কনক নামের একজন বন্ধুর সঙ্গে চুল টানাটানি করে ঝগড়া করেছিলাম’
বিজ্ঞাপন
ছাত্রী হিসেবে খুব বেশি ভালো না হলেও খারাপ ছিলেন না মাহফুজা। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে প্রায় ১২০০ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সপ্তম হয়েছিলেন। স্কুলজীবনের নানা স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। মাহফুজা বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে কবিতা আবৃতিতে প্রথম হয়ে স্যারদের থেকে অসম্ভব প্রশংসা পেয়েছিলাম। সেই স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। আবার দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন আমাদের বনভোজন আয়োজন করেছিল স্কুল থেকে। সেখানে আমি ছাড়া আমার সব বন্ধুরা গিয়েছিলো। এটা এখনো মনে পড়লে কষ্ট হয়।’
বর্তমানে টিউশন আর পাতার শিল্পকর্ম করে সময় পার করছেন মাহফুজা। শুকনো পাতার ওপর পেইন্টিং, সুঁই-সুতা দিয়ে পাতায় কাজ আর ক্যানভাস পেইন্টিং, পেন স্কেচ করছেন তিনি। তার উদ্যোগের নাম ‘লিভিং ইন লিভস’। একে তো পাতা তার ওপর অন্যরকম নাম। কৌতূহল জাগে মনে। প্রথমেই জানতে চাই উদ্যোগের এমন নাম কেন?
বিজ্ঞাপন
মাহফুজা বলেন, ‘এই নামটি আমার এক ভাইয়ের দেওয়া। তার কাছে সাজেশন চেয়েছিলাম। লিভিং ইন লিভসের অর্থ পাতার মধ্যে বসবাস। যেহেতু আমি পাতা নিয়েই কাজ করি তাই এই নামটি একেবারে উপযুক্ত মনে হয়েছিল।’
অনেকক্ষণ ধরে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নটি এবার করেই ফেলি। জানতে চাই, এত এত মাধ্যম থাকতে পাতাকে কেন কাজের মাধ্যম বানালেন? মাহফুজা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ইউনিক জিনিসপত্রের দিকে আমার ঝোঁক ছিল বেশি। সবাই তো ক্যানভাসে আঁকে আর কাপড়ে সুঁই-সুতার কাজ করে। আমার মনে হলো, দুটো কাজই পাতায় করলে কেমন হয়? এমন ভাবনা থেকেই ২০১৯ সালে কাজ শুরু করি। নতুন মাধ্যম হওয়ায় কাজে আনন্দ আর উৎসাহও খুঁজে পাই।’
শুরুটা করেছিলেন পরীক্ষামূলক ভাবেই। এরপর পাতার ওপর সেলাইয়ের কাজগুলো আশেপাশের মানুষদের প্রশংসা কুঁড়াতে থাকে। তখন মাহফুজা ভাবেন, কাজগুলো যদি ফ্রেমিং করে সংগ্রহ করেন আর বিক্রি করেন তবে তা হতে পারে অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম। সেই থেকে শুরু। মাহফুজার প্রথম ক্রেতা ছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আয়েশা ম্যাম।
সবাই মূলত কাগজে, ক্যানভাসে বা কাপড়ে কাজ করে থাকেন। কিন্তু মাহফুজা কাজ করছেন পাতায়। তাই অন্যদের থেকে তার কাজ কিছুটা ভিন্ন বলে মনে করেন তিনি।
এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, ‘মানুষ বরাবরই ভিন্ন কিছু ভালোবাসেন। সব কিছুতেই নতুনত্ব খুঁজে বেড়ান। মানুষ সাধারণত ভাবেন শুকনো পাতা একটি তুচ্ছ ও ভঙ্গুর জিনিস। আমি সেই স্পর্শকাতর জিনিসটিকেই কাজে লাগিয়ে সেটার ওপর রং দিয়ে পেইন্টিং থেকে শুরু করে সুঁই-সুতা দিয়ে সেলাই করছি। সাধারণ পাতায় এক নতুনত্ব ফিরিয়ে আনছি। আমার এই চেষ্টাটুকু মানুষ সুন্দরভাবে গ্রহণ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
মাত্র ১০০০ টাকা মূলধন দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন মাহফুজা। বর্তমানে আয় মাসে ৫০০০-১০০০০। কাজের অর্ডার পাওয়ার ওপর আয় নির্ভর করে। তবে মাহফুজা আক্ষেপ প্রকাশ করে জানান, অনেকেই ভাবেন পাতায় সুঁইয়ের ফোঁড়— এ আমার এমন কী? এই কাজটি যে কতোটা কষ্ট করে, কতখানি দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে তা তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না। শিল্পের কদর তাদের কাছে নেই।
পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এই তরুণী। মাহফুজা বলেন, ‘এক আপু তার মায়ের জন্য আমার থেকে একটা কাজ নেন। আপু প্রাপ্য পারিশ্রমিকের সঙ্গে আমাকে বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলেন চকলেট খেতে। এই স্মৃতি আমার পাওয়া অন্যতম সুন্দর অভিজ্ঞতা।’
আবার সম্প্রতি খুব খারাপ একটি অভিজ্ঞতাও হয়েছে। একটি ফেসবুক গ্রুপে আমার কাজের ছবি পোষ্ট করাতে সেখানে থেকে একটা আপু আমার কাজের মূল্য জানতে চান। আমি তাকে দাম বলাতে উনি সেটা নিয়ে ইনবক্সে অনেক হাসি তামাশা করেন। একই সঙ্গে আমার কথোপকথনগুলোর স্ক্রিনশট নিয়ে অন্য একটা গার্লস গ্রুপে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা, বিদ্রূপ করেন। ব্যাপারটি আমাকে বেশ মর্মাহত করেছিল’- যোগ করেন মাহফুজা।
কাজের ক্ষেত্রে এই উদ্যোক্তা সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে। পরিবারের বাকি সদস্যরাও তার কাছ পছন্দ করেন, নিয়মিত উৎসাহ দেন। মাহফুজা বিশ্বাস করেন, কেউ হাসি ঠাট্টা করলে থেমে যাওয়া চলবে না। বরং নিজের ভালো কাজের মাধ্যমে তাকে লজ্জা দিতে হবে। তাই নিন্দুকের কথায় কান না দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
পাতা নিয়ে কাজ করা মাহফুজা নিজেকে ‘পাতা কন্যা’ পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। একদিন সারা বিশ্ব তাকে এই নামে, তার কাজকে চিনবে এমন স্বপ্ন দেখেন এই তরুণী।
এনএম