সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য আদর্শ স্থান ‘ঝিনাইদহের মহেশপুর’

মো. শাহিন রেজা
প্রকাশিত: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য আদর্শ স্থান ‘ঝিনাইদহের মহেশপুর’

করোনার লকডাউন শিথিল হওয়ার পর আমি মাঝে মাঝে প্রকৃতি দেখতে বের হতাম। এ অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে। ছুটির দিনে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার সাথে থাকতেন। আমাদের নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য মহেশপুরের দত্তনগর কৃষি খামার বেশ চমৎকার একটি যায়গা ছিল। চারদিকে সবুজ ফসলের মাঠ, এক পাশে বিল আর অন্য পাশে বট গাছের ছায়া শীতল পরিবেশ। সন্ধ্যা নামার আগে প্রকৃতির অন্য রূপ ধারনের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তার কবিতা আবৃত্তি এক অন্যরকম আলাদা আবহাওয়া তৈরি করতো। 

ইতিহাসের ছাত্র হলেও সাহিত্যর প্রতি তার বেশ দুর্বলতা আছে। ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, সমাজব্যবস্থা নিয়ে হরহামেশাই আমরা তর্কে জড়িয়ে পড়তাম। অনেক বিষয়ে তার চিন্তার সঙ্গে আমার চিন্তা যোজন যোজন দূরে অবস্থান করতো। তবে বিতর্কের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চমৎকার আলোচনা হতো আমাদের। 


বিজ্ঞাপন


আমরা যে যায়গায় সময় কাটাতাম এখানে আজ থেকে ১৩ বছর আগে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি উঠেছিল। সেই সময় সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা একবার এখানে এসেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে এটি আর আলোর মুখ দেখেনি। কেন এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন সে বিষয় নিয়ে নিয়মিত কথা হতো আমাদের। সাথে দেশের বিভিন্ন যায়গায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এই যায়টা অবহেলিত হওয়ায় লেখার তাগিদ অনুভব করলাম।

সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষা প্রদান ও গবেষণামূলক কাজকর্ম করে থাকে। এছাড়া দেশ ও বিশ্ব বাজারের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ভূমিকা রাখে। বর্তমান সরকার শিক্ষা, গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার চিন্তা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক জেলাতে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। 

moheshpurকেন মহেশপুরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন?

মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা মহেশপুর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে একটি প্রাচীন জনপদের নাম। জনশ্রুতি আছে, দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সেন বংশীয় রাজা মহেশপুরে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী হিন্দুরা এখানে বসবাস শুরু করে। দীর্ঘ দিন হিন্দু জমিদাররা এ অঞ্চল শাসন করেছেন। যারা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। সেই সময় জমিদার বাড়িতে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। শহরে এখনো  তাঁদের ধ্বংস প্রাপ্ত জমিদার বাড়ি ও মন্দির দেখা যায়। 


বিজ্ঞাপন


দেশ ভাগের আগে মহেশপুর ভারতের পশ্চিম বঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁও মহাকুমার অংশে ছিল। ১৯৪৭ সালে এটি ঝিনাইদহ মহাকুমার ও বৃহত্তর যশোর জেলার অন্তর্গত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চা, ইতিহাস ঐতিহ্যে মহেশপুরকে একটি মডেল হিসেবে ধরা যেতে পারে বিভিন্ন কারণে। 

মহেশপুর হাইস্কুল ঝিনাইদহের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মহেশপুরের কৃতি সন্তান। ১৮৬৯ সালে মহেশপুর পৌরসভার স্থাপিত হয়। বাংলাদেশে প্রথম দিকে যে কয়েকটি পৌরসভা স্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে মহেশপুর একটি। ফলে অনেক আগে থেকেই এখানে এক ধরনের নগর কেন্দ্রিক আবহাওয়া বিরাজমান। ৪১৯.৫৩ বর্গ কি. মি. আয়তনের এই উপজেলা কৃষি কাজের জন্য উপযোগী। বিল, বাওড়, জলাশয়, কৃষি ফসল উৎপাদনে পার্শ্ববর্তী যেকোনো উপজেলা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে মহেশপুর। ফলে মহেশপুরকে বলা হয় খাদ্যভান্ডার বা রত্নভাণ্ডার।

মহেশপুর উপজেলার দত্তনগরে বিশাল আয়তন জুড়ে রয়েছে দত্তনগর কৃষি খামার যা বাংলাদেশের বৃহত্তর এবং এশিয়ার বৃহৎ কৃষি খামারগুলোর মধ্যে অন্যতম। আবাদি, নিচু জমি ও বিল নিয়ে গঠিত খামারটি প্রায় তিন হাজার একর জমির উপর অবস্থিত। ১৯৪০ সালে হেমেন্দ্র নাথ সবজি খামার হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত করেন। দেশ ভাগের পর তিনি ভারতের চলে গেলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যায়গাটা অধিগ্রহণ করে। 

moheshpurবর্তমানে বিএডিসির আন্ডারে এখনে বীজ উৎপাদনে করা হয়। কৃষি বিষয়ে গবেষণা বৃদ্ধিতে সরকার চাইলেই এখানে জমি অধিগ্রহণ করে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে পারে। কারণ, ধারণা করা হচ্ছে সামনে পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধ হলে তা হবে খাদ্য নিয়ে। দেশে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। ফলে এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে। খাদ্য পণ্যের জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সরকার এই বিষয়টি অনুধাবন করে কৃষি পণ্য ও খাদ্য দ্রব্য উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। এই কৃষি ও খাদ্য শস্যের নতুন জাত উদ্ভাবন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণার ভূমিকা অপরিসীম।

এখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্র তৈরি হবে যা কৃষি বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অগ্রগামী ভূমিকা রাখবে। 

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেকোনো স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষার্থী ও গবেষকরা সহজেই আসতে পারবেন। এখানকার নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ শিক্ষা ও গবেষণা কাজের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। ফলে ভৌগলিক অবস্থানগত বিবেচনায় এটি একটি উপযুক্ত স্থান। এখানে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা দেখা দিলে পার্শ্ববর্তী বৈঁচিতলা, জলিলপুর-নস্তি সড়কের পাশের মাঠ কিংবা মহেশপুর-নাটিমা সড়কের পাশে স্থান নির্বাচন করা যায়। যেখান থেকে সহজেই দত্তনগর খামারে যাওয়া যাবে। 

কৃষি সংক্রান্ত পাঠদান ও গবেষণার পাশাপাশি এখানে আধুনিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়াদি পড়ানো যেতে পারে। এছাড়াও জলবায়ু বিজ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্ম চর্চা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রকৌশল ও মেডিকেল সাইন্স বিষয়ে বিভিন্ন ইনস্টিটিউট ও গবেষণাগার থাকতে পারে। এক কথায় একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয় যাকে বলে।

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা বিশ্বের সঙ্গে চলতে হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, বিষয় ও গবেষণাতে নতুনত্ব আনতে হবে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে আধুনিক। একটি আধুনিক স্মার্ট রাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষা, গবেষণার সঙ্গে সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মহেশপুরে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হোক যা হবে সারা দেশের রোল মডেল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ মহেশপুরের কৃতি সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে করা উচিত বলে মনে করি।

moheshpurবীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ চাই?

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার জাতির সাত শ্রেষ্ঠ সন্তানকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাবে ভূষিত করে যার মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান একজন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর মার্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে হামিদুর রহমান বাংলাদেশেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যুদ্ধে যোগ দেন। অক্টোবর মাসে তিনি সিলেটের শ্রীমঙ্গল এলাকার ধলই সীমান্তে শহীদ হন। 

হামিদুর রহমান মহেশপুর তথা সারা বাংলাদেশের গর্ব। তাঁর নামে নিজ গ্রামের নাম করণ করা হয়েছে। এছাড়াও তাঁর নামে গ্রামে একটি সরকারি কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলেজ মাঠে নির্মাণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার, ঝিনাইদহ জেলা শহরের স্টেডিয়াম, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম ও মহেশপুরে একটি সড়ক রয়েছে। বাংলাদেশে সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ থাকলেও কারো নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। 

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মহেশপুরের সন্তান আবার এই মহেশপুর উপজেলাতেই রয়েছে বৃহত্তম কৃষি খামার। যেখানকার ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য উপযুক্ত। ফলে সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে অনন্য নজির স্থাপন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এর মাধ্যমে কৃষি, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার পথ যেমন সুগম হবে তেমনই এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ হবে। 

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর