বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ছবিতে জীবন ও প্রকৃতির গল্প বলেন আশরাফুল ইসলাম শিমুল

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২২, ০৫:৪০ পিএম

শেয়ার করুন:

ছবিতে জীবন ও প্রকৃতির গল্প বলেন আশরাফুল ইসলাম শিমুল
আশরাফুল ইসলাম শিমুল

কখনো কখনো মানুষের কাজই তাকে এনে দেয় পরিচয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের নিউজফিডে কিছু চমকপ্রদ স্থিরচিত্র দেখা গেল। ছবিগুলো যেন জীবন্ত। একেকটি ছবি একেক গল্প বলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলে এই ছবিগুলোর পেছনের কারিগর আশরাফুল ইসলাম শিমুল। পেশায় একজন ন্যাচার ও লাইফস্টাইল ফটোগ্রাফার তিনি। 

আড্ডা গল্পে শিমুলের কাছ থেকে জানা গেল ফটোগ্রাফি জীবনের নানা অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির কথা। প্রথম ক্যামেরা কেনার গল্প, ছবি তোলার জন্য পাগলামির কথাও জানতে পারলাম। 


বিজ্ঞাপন


shimulপাবনার ছেলে শিমুল। উড়নচণ্ডী স্বভাবের ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে খুব একটা যেতে চাইতেন না। শিমুল স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘স্কুলের নাম করে ভোর সকালে বেড়িয়ে পড়তাম পাখির খোঁজে। কখনো নতুন ঘুড়ি নিয়ে খোলা মাঠে ছুটতাম। কখনো বরষার পানিতে দাপড়িয়ে বেড়াতাম শাপলার খোঁজে। এই গাছ থেকে সেই গাছে ছুটতাম। সব মিলিয়ে খুব দুরন্ত ছিলাম আরকি।’

পাবনাতে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে নাটোরে শেষ করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক শেষ করেছেন। 

shimulতখন শিমুল অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বন্ধুদের অনেকের ক্যামেরা ছিল। সেই ক্যামেরা দেখে মাথায় এসেছিল তারও ক্যামেরা কেনা দরকার। যদিও এর আগে মুঠোফোন দিয়ে সেলফি, নিজেদের বা ফুলের ছবি তুলতেন কিন্তু ফটোগ্রাফি কি তা বুঝতেন না। ২০১৭ সাল থেকে ছবি তুলতেন এই তরুণ। ফটোগ্রাফির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তার। তবে ভালোলাগার কাজটির পেছনে লেগেছিলেন। এরপর ইউটিউব, গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি থেকে নানা উপায় জেনেছেন, শিখেছেন। ছবি তোলার হাত ঝালাই করেছেন। 

শিমুলের কাছে প্রথম ক্যামেরা কেনার গল্প শুনতে চাই। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সাল এ আমি চারটি টিউশনি করাতাম। ১৮ হাজার টাকা আমার পকেটে আসতো। ফলে মাসে মাসে আমার কাছে ভালোই টাকা থেকে যেত। কয়েকমাস পরে দেখি আমার কাছে প্রায় ৫০ হাজারের ওপরে টাকা জমে গেছে। তখনই আসলে ক্যামেরা কেনা হয়ে গেল। টিউশনির টাকা দিয়ে ক্যামেরা কিনেছিলাম। যদিও কিছু টাকা ধার করতে হয়েছিল লেন্স কিনতে।’


বিজ্ঞাপন


shimulক্যামেরা হাতে দেশের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ছুটে গেছেন শিমুল। প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষের সাধারণ জীবনযাপন ক্যামেরা ফ্রেমে আটকেছেন। ট্রাভেল ফটোগ্রাফি করেন তিনি। প্রকৃতিও ভালোবাসেন। ছবি তোলার ক্ষেত্রে ফিক্সড সাবজেক্টের চেয়ে চোখের সামনে যা ভালো লাগে তাকে বেশি গুরুত্ব দিতে ভালোবাসেন। 

ছবি তুলতে গিয়ে কোনো পাগলামি করেছেন নাকি জানতে চাইলে এই তরুণ বলেন, ‘অনেক পাগলামি করেছি। পরীক্ষা মিস দিয়েছি, বাস থেকে মাঝ পথে নেমে হেঁটে হেঁটে বহুদূর গিয়ে সেখানেই রাত থেকে গেছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে এক জায়গায় বহুবার বহুদিন বসে থেকেছি।

shimul‘একবার সেমিস্টার ফাইনাল চলছিল। সেই সেমিস্টারের একটা সাবজেক্টের পরীক্ষা বাদ দিয়ে আমি ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। আবার একবার ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলাম বাসে করে। টাঙ্গাইলে বাস থেকে জেলেদের মাছ ধরার একটা সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ছিল। তখন বাস থেকে নেমে গিয়ে ছবি তুলেছিলাম।’- যোগ করেন শিমুল

পরিবার চেয়েছিলেন তিনি ডাক্তার হোক। শিমুল নিজে চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হতে। পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনাও করেছিলেন। কিন্তু মাঝ পথে এসে জীবনের পথ অন্যদিকে ঘুরে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং ভালোবাসা ছেলেটি আনন্দ খুঁজে পেলেন ছবি তোলাতে। 

shimulশিমুল বলেন, ‘আমার এই অদ্ভুত আচরণে পরিবার হতবাক হয়ে গিয়েছিল। যদিও আমি আমার মতোই চলেছি ছোটবেলা থেকে। পরিবার এখনো জবের কথা বলে। আমি তাদের জানিয়ে দিয়েছি ফটোগ্রাফি নিয়ে থাকবো এবং আছি। এখন পরিবার মেনে নিয়েছে। যদিও জবের জন্য তাদের আশা ছাড়েনি। তবে ফটোগ্রাফি ছাড়তে কখনো জোরও করেননি। 

অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পালকির সঙ্গে যুক্ত আছেন শিমুল। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফির প্রতিষ্ঠান এটি। পালকির যাত্রার গল্প জানতে চাই তার কাছে। শিমুল বলে, ‘২০১৮ সালে পালকির যাত্রা শুরু হয়। এই পেজ খোলা একটা গল্প আছে। নাম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার আধুনিক বা ইংরেজি নাম খুব একটা পছন্দ না। তাই খুঁজতে খুঁজতে এমন একটি সাধারণ নাম বেছে নিলাম যে নামের সাথে সবাই পূর্ব পরিচিত। যা বিয়ের যাত্রা বহন করে। যা বহু যুগ ধরে খুব সুন্দরভাবে বিয়ের সঙ্গে জড়িত। সেই পালকিকেই বেছে নিলাম প্রতিষ্ঠানের নাম হিসেবে।’

shimul‘পালকির যাত্রা শুরু করার কারণ ভিন্ন ছিল। আমি অনেক ভ্রমণ করতাম। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। ভ্রমণ করার মতো টাকা ছিল না আমাদের কাছে। তখনও আমরা ছাত্র ছিলাম। তাই টাকার অনেক অভাব ছিল বলতে পারেন। এজন্যই পালকির যাত্রা। ইভেন্ট করে, টাকা কামাই করে, আমরা সেই টাকা দিয়ে প্রচুর ঘুরতাম, ফিরতাম মজা করতাম। আমাদের কখনোই এই পালকিকে প্রফেশনাল হিসাবে দাঁড় করানোর ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ইভেন্ট করতে করতে আজ পালকি একটা ফুল প্রফেশনাল টিম হয়ে দাঁড়িয়েছে।– যোগ করেন শিমুল। 

এই পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে ১৫০ এর বেশি পুরস্কার জিতেছেন এই তরুণ আলকচিত্রী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো Environment photographer of the year award, wiki love earth award, Bangladesh tourism broad award, Ruchi beautigram award, frasthand award, 50 water story award, pixmama award, 35award ইত্যাদি। উইকি লাভ ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার জেতেন তিনি। 

shimulপুরস্কার জেতায় অনুভূতি প্রকাশ করে শিমুল বলেন, ‘পুরস্কার পাবার অনুভূতি আসলেই ভিন্নরকম। তবে আরও দায়িত্ব বেড়ে গেছিল। ছবি তোলার প্রতি প্রবল নেশা বেড়েছিল। সব পুরস্কারই আমার খুব প্রিয়।  যদিও পুরস্কারের জন্য ছবি তুলিনি কখনো। তবে পুরস্কার পেলে অনুপ্রেরণা বাড়ে, পরিধি বাড়ে, দেশের সুনাম বাড়ে, মানুষ চিনে ও জানে।’

ব্যক্তিগতভাবে শিমুল একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। ভ্রমণ করা তার পছন্দের তালিকায় প্রথম। কাজটিকে তিনি আত্মার স্পন্দন মনে করেন। শিমুল বলেন, ‘ভ্রমণ করতে গিয়ে জীবনে বহুত ছবি পেয়েছি। ছবির মধ্যে অনেক ভিন্ন রকম গল্প পেয়েছি। মানুষের চরিত্র, মানুষের জীবিকার পার্থক্য পেয়েছি। জেনেছি ভিন্ন ভিন্ন গল্প, ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন, ভিন্ন ভিন্ন জীবন জীবিকার পথচলা। খুঁজেছি নিগূঢ় সৌন্দর্য, পেয়েছি শান্তি।’

shimul‘একটি সুন্দর ছবি আমাকে দিয়েছে প্রশান্তি। সেই প্রশান্তির জন্যে ছুটে চলেছি ছবির পিছনে, গল্পের পিছনে,  ফ্রেমের পিছনে, মানুষের পিছনে, ভ্রমণের পিছনে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়’- আরও বলেন তিনি। 

ভবিষ্যতেও ভ্রমণ আর ফটোগ্রাফিকে সঙ্গী করেই পথ চলতে চান এই তরুণ। 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর