সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বাঙালির মুক্তির রাষ্ট্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালিয়ানা সব খাবার ছিল তার প্রিয়। দেশ বিদেশে শতবার পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। নানা দেশের নানা খাবার চেখে দেখেছিলেন। তবুও আত্মতৃপ্তি খুঁজে পেয়েছিলেন বাঙালি খাবারেই।
ছেলেবেলা থেকেই মাছপ্রেমী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাজা কই মাছ ছিল তার অন্যতম প্রিয় খাবার। যেকোনো দেশীয় মাছের তরকারি দিয়ে সাদা ভাত খেতেন তৃপ্তি নিয়ে। প্রিয় মাছের তালিকায় আরও রয়েছে কই, পুঁটি, টেংরা, মলা, পাবদা ইত্যাদি। পাতে মাছের সঙ্গী করতেন সাদা ভাত। কোনো বেলায় সঙ্গে ডাল আর করলা ভাজি থাকলে জমে উঠত তার ভোজন।
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলায় আরও একটি খাবার পছন্দের ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। দুধ-কলা দিয়ে গরম ভাত মাখিয়ে খেতে ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। সঙ্গে মিশিয়ে নিতেন গুড়। এই খাবার না খেলে নাকি ছোটবেলায় তার খাওয়াই পূর্ণতা পেত না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত গ্রন্থ সংকলন ‘কারাগারের রোজনামচা’। এর নামকরণ করেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ৯৮তম জন্মবার্ষিকীতে গ্রন্থটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর পছন্দের খাবার নিয়ে বেশকিছু লেখা আছে।
কারাবন্দি অবস্থায় কী খেতেন, কীভাবে খাবার উপভোগ করতেন তা নিয়ে বিশদ বর্ণনা বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে লিখেছেন। তিনি ছিলেন অকুতোভয়। কারাগারের জীবনকেও উপভোগ করেছিলেন রান্না শিখে, রান্না করে। পটল ভাজি, ইলিশ রান্না সবই শিখেছেন সেই সময়ে।
বিজ্ঞাপন
রান্নায় খুব বেশি জ্ঞান না থাকলেও শখের বসে রাঁধতেন তিনি। নিজে খেতে এবং অন্যদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন। তাই প্রায়ই অতিথি কাউকে পাশে বসিয়ে নিতেন। কলিজা, ফলি মাছ, খিচুড়ি রাঁধতে গিয়ে যে ধকল পোহাতে হয়েছে তারও উল্লেখ করেন তিনি ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে। তবে হাল না ছেড়ে এসব পদ রান্না শেখেন এই নেতা।
সাধারণ মুড়িমাখাও যে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা যায় তা বঙ্গবন্ধুর লেখায় ফুটে ওঠে। অতি সাধারণ এই খাবারটি তৃপ্তি নিয়ে খেতেন তিনি। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার বাড়িতে মুড়ি খাবার অভ্যাস। কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ, আদা আর সরিষার তৈল দিয়ে একবার মাখলে যে কী মজা তাহা আমি প্রকাশ করিতে পারি না। আমার না খেলে চলে না।’
এই মুড়িমাখা যে একা খেতেন তা নয়। সঙ্গীদের নিয়ে উপভোগ করতেন। গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মুড়ি জেলখানায় খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সিপাহি, জমাদার ও কয়েদিদের মধ্যে অনেকে পালিয়ে মুড়ি খেতে আসে।’
বাড়িতে শেখ মুজিবকে তার প্রিয় খাবারগুলো নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন বেগম মুজিব। কোনো সরকারি বাবুর্চি ছিল না। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তখনও নিজ হাতে বেগম মুজিব রান্না করে খাইয়েছেন। বাইরে কোথাও খেতে হলে টিফিন ক্যারিয়ার করে খাবারও দিয়ে দিতেন। খাবার হিসেবে বেশিরভাগ সময়ই থাকত কই মাছ, সবজি, লতি ইত্যাদি। সঙ্গে ডাল আর সাদা ভাত। চার-পাঁচজন ভরপেট খেতে পারতেন সেই খাবার।
খাবারের পর মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাই ডেজার্ট হিসেবে থাকত ডিমের পুডিং। এক আঙুল দিয়েই মাঝেমধ্যে এই পুডিং খেয়ে নিতেন বঙ্গবন্ধু। নানা সূত্র অনুযায়ী, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরী পছন্দ করতেন তিনি। এছাড়া নাটোরে গেলেই তিনি ভাতের সঙ্গে খেতেন ছাঁটা ডাল। মুগ ডাল ঘিয়ে ভেজে তৈরি হতো এই ডাল।
বাবার পছন্দের খাবার নিয়ে ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ে লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বইয়ের ২৭ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার আব্বা ছিল বেশ রোগা। আমার দাদি সবসময় ব্যস্ত থাকতেন কীভাবে তার খোকার শরীর ভালো করা যায়। তাই দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরি হতো। বাগানের ফল, নদীর তাজা মাছ সবসময় খোকার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকত।’
বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খাবার নিয়ে এমন নানা স্মৃতির কথা শোনা যায়। তিনি নানা দেশে ঘুরেছেন, নানা খাবার খেয়েছেন। তবে বাঙালির সাধারণ মাছ, ভাতেই খুঁজে পেয়েছেন তৃপ্তি।
এনএম

