বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

স্মৃতির পাতায় সদা রঙিন বন্ধু আর বন্ধুত্ব

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ০৮ আগস্ট ২০২২, ০৪:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

স্মৃতির পাতায় সদা রঙিন বন্ধু আর বন্ধুত্ব

বন্ধু দিবস তৈরি হওয়ার অনেক কারণের কথা জানা যায়। এর একটি হলো, ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। এর প্রতিবাদে পরদিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এর পর থেকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। 

বন্ধু দিবস উদযাপনের মোড় আরেকটু ঘুরিয়ে দেন প্যারাগুয়ের চিকিৎসক র‌্যামন আর্থেমিও ব্রেচ। তিনি ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। এরপরই বিশ্বব্যাপী ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বন্ধুত্ব, ঐক্য ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে গঠন করা হয় ‘বন্ধুত্ব ক্রুসেড’। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের ২৭ জুলাই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ৩০ জুলাইকে বন্ধু দিবস ঘোষণা করেন। কিন্তু এখনও বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করার চল রয়েছে। 


বিজ্ঞাপন


দুই.
কাজে-অকাজে বছরভর বন্ধুত্ব। বিশ্ব বন্ধু দিবস মনে করিয়ে দিচ্ছে, এখনও হাত বাড়ালেই বন্ধু পাওয়া যায়। মা-বাবা, পরিবারের পরে যদি জীবনে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেউ থাকেন, তিনি বন্ধু। আমার জীবনের অংশ। এমন অনেক কথা আছে যা সবাইকে বলা যায় না। এমন অনেক অনুভূতি আছে, যা কেবল বন্ধুর সঙ্গে সহজে ভাগ করে নেওয়া যায়। এই একটি সম্পর্কের কাছে সবাই অনর্গল।

bondhuতিন. 
মুশফিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নানামুখি আলাপ-সালাপ। ও আমাকে একটা প্রশ্ন করে—‘তোর বন্ধু ভাগ্য কি খারাপ?’ ওর এই প্রশ্নটা আমাকে ভীষণ আলোড়িত করে। দোনামনা করে কাটল বেশ কয়েকটা দিন। 

না। কখনোই বন্ধু ভাগ্য আমার মন্দ ছিল না। জীবনের বিভিন্ন পর্বে বন্ধুরা আমার পাশে ছিল। তার জন্যই আজ কর্কটময় পথগুলো পাড়ি দিতে পারছি। ওদের প্রতি আমার ভালোবাসা সবসময়।

আমাদের গৌরগোপাল স্যারের ছেলে শিবু দেবনাথ। জেলা স্কুলে যখন প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম, তাদের মধ্যে শিবু ও সজীবের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আমরা তিনজনই এক সঙ্গে বসতাম। একসঙ্গে স্কুলে ঢুকতাম। হঠাৎ একদিন কী একটা বিষয়ে শিবুর সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তারপর থেকে অনেক বছর আমাদের মধ্যে কথা হয়নি। মাঝে মাঝে দেখা হতো, কিন্তু কথা হতো না। হঠাৎ দুই বছর আগে আমাদের ব্যাচের রিইউনিয়নের কাজ করতে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা হয়, প্রায় ২২ বছর পরে। এরমধ্যে স্কুল পাসের পরে সজীবের সঙ্গে দেখা হয়নি। এখন আমি আর শিবু বেশ ভালো বন্ধু। 


বিজ্ঞাপন


সাবরুন আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন। একবার ঈদে আমি আর সাবরুন আমাদের আরেক বন্ধু রিজনকে সাথে নিয়ে হাজির হলাম অশ্বদিয়ায়, আমাদের আশেকদের বাড়িতে। শহর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার হবে। তিনজনে তিনটা সাইকেল চেপে আবার ফিরে এলাম। অনেক মজা ছিল এ ভ্রমণ। 

bondhuস্কুলে পড়ার সময়ে সাবরুন, আমি, রিজন তিনজনই টাকা জমাতাম। দশ টাকা করে মাসে। কয়েকমাস পরে আমাদের টাকা জমানো বন্ধ হয়ে যায়। একসঙ্গে আমরা একেকজন পেলাম বেশ কিছু টাকা। ওই সময়ে এগুলো ছিল অনেক টাকা। 

কলেজ জীবনে এক বন্ধু ছিল ফওজিয়া চৌধুরী ইভা। কলেজের রোভার স্কাউটে পরিচয়। সংগঠনের কাজে ওদের বাসা যেতাম। ইভা ছিল ভীষণ চনমনে। কল্পনাতীত জগতে থাকতে পছন্দ করতো। একদিন সে আমাকে বলছে, ‘তুই আর আমি একটা অফিসে চাকরি করবো। দুপুরে খাওয়ার সময় হবে, তখন আমি আর টেবিলের ড্রয়ার থেকে সব এক প্যাকেট বিস্কিট বের করবো। তারপর দুজনে খাবো।’ হঠাৎ করে ইভার বিয়ে হয়ে যায়। ওর মা ছিল না। সংসারের বড় মেয়ে সে। পুরো সংসারের দায়িত্ব ছিল তার। বিয়ের পর ইভার সাথে আর দেখা হয়নি। 
    
চার.
আমার ধাপে ধাপে বড় হওয়া, শরীরের পরিবর্তন, মেজাজ-রুচির রকমফের সব জানে এক বিশেষ বন্ধু। আমিও ওর সব কিছু জানি। আজ এত বছর পরেও চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি, বন্ধু দিবসে আমার ছোটবেলার বন্ধু কী বলবে আমাকে! বড়বেলার বন্ধু সঙ্গে ছেলেবেলার বন্ধুর এটাই মস্ত ফাঁক আছে। বড় হয়ে যাওয়ার পরেও বন্ধুর প্রয়োজন পড়ে। জীবনের ওঠাপড়া, চোট-আঘাত, ভাঙাগড়া ভাগ করে নিতে। হয়তো নতুন করে বন্ধুত্ব পাতাতে হয়। কিন্তু বন্ধুত্বের একটা সুবিধা, একে লালন করতে প্রতি মাসে দেখা করতে হয় না। রোজ ফোনে কথাও বলতে হয় না। বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে উপঢৌকনও লাগে না। যখনই বন্ধুর সঙ্গে দেখা, তখনই চারপাশে হারানো দিন হাজির! 

bondhuপাঁচ.
ইতিহাস সাক্ষী অসাধারণ কিছু বন্ধুত্বের। একজন সত্যিকারের বন্ধু কখনোই তার বন্ধুকে ছেড়ে যায় না। সুখে-অসুখে, আপদে-বিপদে সব সময়ই ছায়ার মতো পাশে থাকে। সব সম্পর্কের সেরা সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। 

শ্রীকৃষ্ণকে একবার বন্ধুত্ব আর প্রেমের মধ্যে কোন্টির মূল্য বেশি বলে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, ‘প্রেম হলো সোনার মতো, যা ভেঙে গেলে আবার নতুন করে গড়া যায়। কিন্তু বন্ধুত্ব হলো হীরার মতো, যা একবার ভেঙে গেলে আর গড়া যায় না। অবশ্যই বন্ধুত্ব বেশি মূল্যবান।’ এই সুরে সুর মিলিয়েছেন নামি-দামি অনেক বরেণ্য ব্যক্তিও!

উইলিয়াম শেকসপিয়ারও গেয়েছেন বন্ধুত্বের জয়গান। কাউকে সারাজীবনের জন্য কাছে পেতে হলে তাকে প্রেম দিয়ে নয়, বরং বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখার কথা বলেছেন তিনি। আর কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘প্রেম একসময় হারিয়ে যায়, কিন্তু বন্ধু কখনোই হারায় না।’

কোরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন নিজের জীবনবাজি রেখে নবীজির হিজরতে সঙ্গী হন আবু বকর (রা.)। যিনি ছিলেন নবীজির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।

ছয়.
অনেকেই আবার মনে করেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে যায় অনেক সম্পর্কই। কিন্তু বন্ধুত্ব হলো এমন এক তেঁতুল। এটা যতই পুরনো হয় এর আয়ুর্বেদ ক্ষমতা ততই বাড়ে। ভার্চ্যুয়াল জগতের অসংখ্য মানুষের ভিড়ে নতুন সবকিছু উৎকৃষ্ট মনে হলেও, পুরনো বন্ধুত্ব থেকে যায় উৎকৃষ্টতার তালিকায়!

bondhuজীবনের কিছু ক্ষেত্রে আর কাউকে না পেলেও বন্ধুদের পাওয়া যায়। যেমন ধরুন আপনি একটা নতুন কিছু শুরু করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই বাধা আসছে, নানান কথা বলছে মানুষ। আপনি খুব হতাশ হয়ে ভেঙে পড়েছেন। এমন সময় ভরসার হাত বাড়িয়ে দেন একজন প্রকৃত বন্ধুই। আপনার বন্ধু যখন বলে, ‘দোস্ত আমি জানি এটা তুই না পারলে আর কেও পারবে না।’ ব্যস! নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কি এটুকুই যথেষ্ট নয়? দুঃসময়ে যখন কেউ আমাদের ব্যথা বুঝতে চায় না, তখনো সত্যিকারের বন্ধু আমাদের পাশে থাকে। জীবনের এ দুঃসময়গুলোতে বন্ধুদের অবদানের কথা ভেবেই হয়তো গায়ক তপু গেয়েছেন,‘তোরা ছিলি, তোরা আছিস জানি তোরাই থাকবি...বন্ধু...বোঝে আমাকে।’

বন্ধু মানে কারণে-অকারণ মান-অভিমান। বন্ধু মানে একই সুরে গান। বন্ধু মানে হতাশার সাগরে একটুখানি আশা, বন্ধু মানে এক বুক ভালোবাসা। দিন শেষে কিন্তু বন্ধুরাই থেকে যায়।

সাত.
বন্ধু যে শুধুই সহপাঠী অথবা সমবয়সী হতে হবে, এমন কিন্তু না। যেকোনো বয়সের মানুষের সঙ্গেই গড়ে উঠতে পারে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। আর এই বন্ধুত্ব হতে পারে মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে, সহকর্মীর কিংবা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে। বছরের শুধু এই একটি দিন বন্ধু দিবস নয়। বছরের প্রতিটি দিনই আমাদের বন্ধু দিবস। কারণ, অন্যদের ছাড়া বাঁচা গেলেও বন্ধু ছাড়া জীবন অসম্ভব!

আমরা যেন অগাধ সমুদ্রে জাল ফেলেছি। কিন্তু যতবারই জাল তুলছি, কিছুই উঠছে না! কারণ, জালের ফাঁকগুলো এত বড় যে, ওই ফাঁক দিয়ে সবই গলে পড়ে যাচ্ছে! তবু জাল ফেলেই চলেছি। কারণ, জাল ফেলাটাই উৎসব! ওটাই আনন্দ! একইসঙ্গে কার জাল কত বেশি দামি, তা নিয়ে অহংকারও করে চলেছি!

এইচই/এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর