'বন্ধু ভাগ্য' বলতে যা বুঝায়, আমার তা কদাচিৎ-ই আছে। মানে, আমার বন্ধু নাই তা বলছি না। মানুষ যতো সহজে বন্ধু পায় আমি ততো সহজে পাইনি এই জীবনে। কখনো দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম টিপড়া পাড়ায় গিয়ে পেয়েছি, কখনো পেয়েছি মাঝরাত্তিরে গা ছমছমে হাইওয়েতে বাইক নিয়ে বৃষ্টির প্রকোপ থেকে আশ্রয় নিতে গিয়ে।
মানুষ এমনিতে 'বন্ধু' বলতে যা বোঝে, আমি সেই 'বন্ধু' নিয়ে লিখছি না। এই তো, দিন পনেরো আগের কথাই বলি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরবো। অফিশিয়াল ইমার্জেন্সির কারণে বিমানে ফিরতে হবে। বিমানবন্দরের কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে সবচেয়ে নিকটবর্তী ফ্লাইট পাওয়া গেলো দুই ঘণ্টা পরের। সেটাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সব কাউন্টারই ঈষৎ জনাকীর্ণ- টিকিট সংকটের কারণে।
বিজ্ঞাপন
টিকেটের টাকা দেওয়ার সময়ে কাউন্টার থেকে জানানো হলো আমার দেওয়া একটা নোট ছেঁড়া, সেটা চেঞ্জ করে দিতে। আমি মানিব্যাগে হাত দিয়ে দেখি ক্যাশ টাকা আর নেই। মোবাইল ট্রানজেকশন থেকে টাকা তুলে এনে দিতে গেলে, ততোক্ষণে টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য।
পিছন থেকে বেশ সাদামাটা (রুগ্ন চেহারার) এক তরুণ এক হাজার টাকা বের করে কাউন্টারে দিয়ে বললেন- ‘এই যে নিন, ওনাকে টিকিট দিন।’ আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই তরুণ বললেন, ভাই আপনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনার ঢাকায় যাওয়া খুবই জরুরী, টিকিট মিস হলে সমস্যায় পড়বেন। আপনি আগে টিকিটটা নিন, আমার টাকার কথা পরে ভাবেন।
টিকিট কেটে বিমানবন্দরের বাইরের দিকে একটা ক্যাফেতে বসলাম। জানলাম, তিনি আনোয়ারা এলাকায় একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে জরুরীভাবে ঢাকায় রওনা দিয়েছেন। এমনিতে বিমানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। একবারের বিমান ভাড়া দিয়ে হয়তো তার পরিবারের এক সপ্তাহের বাজার অনায়াসে চলে যাবে। কিন্তু সবার আগে মা। মায়ের চিকিৎসার জন্যই তিনি উড়াল দিয়ে চলে যাচ্ছেন তার কাছে। এই যে সীমিত উপার্জনের এক অপরিচিত তরুণ আমাকে উপস্থিতভাবে সাহায্য করলেন সেদিন, তাঁকে কি আমি বন্ধু বলবো না?
বিজ্ঞাপন
গত আট/নয় বছর যাবত একটা ব্যাপার ঘটছে আমার সঙ্গে। যখন জীবনের চাপে নাভিশ্বাস উঠে যায় তখন একটা শিশুর দ্বারস্থ হই আমি। তার সঙ্গে মন খুলে বলি সারাদিনের সবকিছু। তখন সে একেবারেই নবজাতক। এখন সে বালক। তখন সে কথা বলতে শিখেনি। এখন সে কথা বলতে শিখেছে। আমি বাসায় ফিরলে সে এখন জিজ্ঞেস করে- আজকে কী কী হয়েছে মামাই? কাউকে মারা লাগবে মামাই? কেউ কি তোমাকে বকা দিয়েছে?
আমি ফ্রেশ হতে হতে তার এসব কথার জবাব দিই। তারপরে তার সারাদিনের সব ঘটনা শুনি। বিচার সালিশ করা লাগলে সেটারও আশ্বাস দিই। তারপরে সে নিজের ঘরে চলে যায়। গিয়ে তার মায়ের কাছে বলে- মামাই বলছে তোমার খবর আছে! শিশুটির নাম মিশকাত। আমার একমাত্র ভাগিনা। আমি কেনো যেন টের পাচ্ছি- আমার মৃত্যুর পরে এই পৃথিবীর যে তিন জন ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি একাকিত্বে ভুগবে তাদের একজন হবে এই মিশকাত।
আবার আমার স্কুল জীবনের সব চাইতে পুরনো এবং বিশ্বস্ত বন্ধু সুফিয়ান সম্প্রতি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে। সে যখন এই খবর আমাকে জানিয়েছে আমি তখন অফিসের নিচে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। কেনো যেন আনন্দে আমার চোখ ভিজে আসলো। আমার সুফিয়ান বাবা হয়ে গেছে! কত্তো ছোট্টবেলার সেই সুফিয়ান! শৈশবের কত শত স্মৃতি! আলহামদুলিল্লাহ সুফিয়ান-বুশরা এখন বাবা-মা!
ভাবতে ভাবতে, চোখ মুছতে মুছতে, হাসতে হাসতে, অফিসে উঠে গেলাম।
লেখক: টিম লিড, ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট ডিপার্টমেন্ট, ব্রাইট স্কিলস
এনএম