শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘পাখি, আমি আজও তোমাকে খুঁজি’

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ০৭ আগস্ট ২০২২, ১০:৪৩ এএম

শেয়ার করুন:

‘পাখি, আমি আজও তোমাকে খুঁজি’
মাহমুদা আক্তার রোজী

ছোট ছোট পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরিবারের মানুষগুলোর বাইরে নতুন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। সহপাঠী হলেও তাদের কেউ কেউ হয়ে যায় বন্ধু। একই বাসায় থাকা সূত্রেও কেউ কেউ বন্ধু হয়ে যায়। সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেকে আবার হারিয়েও যায়। মাঝে মাঝে অবচেতন মন বলে ওঠে, বন্ধু… আবার যদি দেখা হয়ে যেত তোর সঙ্গে! 

পেশায় একজন ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট অ্যান্ড জেরোন্টলজিস্ট মাহমুদা আক্তার রোজী। এক্সট্রা মাইল এইজ কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন তিনি। ছেলেবেলার বন্ধুকে অদ্ভুতভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন রোজী। আবার হারিয়েও ফেলেছেন। আনন্দ আর কষ্ট মিশ্রিত সেই বন্ধুর গল্প ঢাকা মেইলকে শুনিয়েছিলেন তিনি। 


বিজ্ঞাপন


উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে তখন মেডিকেল জীবনে পা রেখেছিলেন রোজী। বাংলাদেশ মেডিকেলের হোস্টেলে সিট না থাকায় উঠেছিলেন লালমাটিয়া মহিলা হোস্টেলে। রাজধানীর লালমাটিয়ায় অবস্থিত বেসরকারি এই হোস্টেলে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীরা থাকতে পারতেন। 

rozyরোজী বলেন, ‘হোস্টেলে আমার রুমমেট ছিল তানজিলা নামের একটি মেয়ে। বেশিরভাগ সময়ে মেয়েটি রুমে থাকতো না। তার বড় বোন ঢাকায় থাকার কারণে বোনের বাসায় থাকতো। তাই রুমের অন্য মেয়েদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠলেও তানজিলার সঙ্গে ছিল নামমাত্র কুশল বিনিময়ের সম্পর্ক।’ 

একবার রমজানে বেশ কয়েকদিন হোস্টেলে থাকেন তানজিলা। এক রাতের কথা। সেদিন কোনো এক কারণে তার ভীষণ মন খারাপ। এদিকে ইলেকট্রিসিটি নেই। রোজী আর তানজিলা বারান্দায় গিয়ে বসেন। চাঁদের আলোয় শুরু হয় দুজন স্বল্প পরিচিত তরুণীর আড্ডা। 

সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে রোজি বলেন, ‘তানজিলার বাবা মা ঘোড়াশালে থাকেন। আমার বাড়ি চাঁদপুর শুনে সে জানায়, তার পরিবারও একসময় চাঁদপুরে থাকতো। ক্রমশ আমরা গল্পে ডুবে যাই। ছেলেবেলার গল্পে তার পরিচিত এলাকা আমার চেনা চেনা লাগে। মানসপটে ফুটে উঠে শৈশবের এক বন্ধুর কথা। ওরা দুই বোন আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। ওদের বাসাটা অনেকটা রাজাদের বাড়ির মতো ছিল। সে বাসার ছাদে আমরা কত খেলা খেলেছি।’


বিজ্ঞাপন


‘আমি তানজিলাকে আমার সেই বন্ধুদের কথা বলি। ও জানতে চায়, আমার সেই বন্ধুদের নাম। তাকে জানাই বন্ধুর ডাক ছিল পাখি। তার বড় বোনের নাম লাকি।’ যোগ করেন রোজী

rozyএরপরই ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। হঠাৎ রোজীর হাত চেপে ধরেন তানজিলা। আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘রোজী, আমিই সেই পাখি’। অনেক বছর পর হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে দুজন দুজনের হাত আরও শক্ত করে ধরেন। যেন হাতটা ছেড়ে দিলেই পরস্পরকে হারিয়ে ফেলবেন। 

এরপরের দিনগুলো রঙিন হয়ে ওঠে দুজনের। রোজী বলেন, ‘আমরা নিয়ম করে সারারাত গল্প করতাম। হোস্টেলে সাধারণত খাবারের মান ভালো থাকে না। পাখি ভালো রান্না করতে জানতো। সে প্রতিদিন আমার জন্য কিছু না কিছু রান্না করতো। গল্পে, আড্ডায়, মায়া মমতায় দিনগুলো স্বপ্নের মতো লেগেছে।’

‘তখন বয়স ছিল অল্প, মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বাবা-মা, পরিবারের সবাইকে ছেড়ে হোস্টেলে থাকতে ভীষণ কষ্ট হতো। খাবারের কষ্ট, আপনজন কাছে না থাকার কষ্ট, মায়া-মমতা মাখা কথা না শোনার কষ্ট— সব কিছু পাখিকে পেয়ে মুছে গিয়েছিল’- আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন রোজী। 

rozyতবে বেশিদিন সেই হোস্টেলে থাকা হলো না তাদের। রোজীর ভাই ঢাকায় পড়তে আসার সুবাদে তিনি আলাদা বাসা ভাড়া নেন। হোস্টেল ছেড়ে দেন। পাখিও তার বোনের বাসা থেকে কলেজে আসবে ভেবে হোস্টেল থেকে চলে যায়। তখন মোবাইল ছিল না কারোরই। জানা ছিল না যোগাযোগের কোনো উপায়। তাই ফিরে পাওয়া বন্ধুটিকে আবারও হারিয়ে ফেলেন রোজী। 

আজও হারিয়ে ফেলা বন্ধুকে মনে মনে খুঁজে বেড়ান তিনি। লালমাটিয়া মহিলা কলেজে সেই সময়ে অনার্স পড়া পাখিকে প্রায়ই মনে পড়ে তার। কোনো ছবিও নেই যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটি পোস্ট করে বন্ধুকে খুঁজবেন। 

সময়ের স্রোতে হারানো বন্ধুর উদ্দেশ্যে তাই রোজী বলেন, ‘পাখি, আমি আজও তোমাকে খুঁজি। যদি এই লেখা দেখে থাকো, তাহলে প্লিজ যোগাযোগ করো। আমি আজও তোমার অপেক্ষায় আছি। অনেক গল্প জমে আছে যে।’

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর