সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ঢাকা

ডেন্টিস্ট থেকে সফল অনলাইন উদ্যোক্তা তুষ্টি

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ২৪ জুলাই ২০২২, ০১:১৮ পিএম

শেয়ার করুন:

ডেন্টিস্ট থেকে সফল অনলাইন উদ্যোক্তা তুষ্টি

কথায় বলে একসঙ্গে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। এই প্রবাদবাক্যটির মাধ্যমে বোঝানো হয়, একজন মানুষ একসঙ্গে দুটি কাজ সঠিকভাবে করতে পারেন না। কেউ কেউ এই কথাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করেন। নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, কাজের প্রতি একাগ্রতার মাধ্যমে সবদিক সামলে নেন সমানভাবে। এই যেমন নুযহাত ফাতেমী তুষ্টি। পেশায় একজন ডাক্তার তিনি। ডেন্টাল সার্জন হিসেবে কর্মজীবন পার করেছেন। এর পাশাপাশি অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবেও পরিচয় দাঁড় করিয়েছেন। ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি কী করে তিনি একজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন? নাকি আগে ব্যবসায়ী হয়ে পরে ডাক্তার হলেন? তার ব্যবসায়িক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন ঢাকা মেইলকে। 

তুষ্টির জন্ম ঢাকাতে। শৈশবের কিছুটা সময় চট্টগ্রামে কাটালেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকাতেই। ছেলেবেলার স্মৃতি হাতড়ে কেবল পড়াশোনাই খুঁজে পান তিনি। এই শহরের আর দশটি শিশুর মতোই বেড়ে উঠেছেন আরকি। স্কুল, পরীক্ষা, পড়াশোনা এভাবেই কেটেছে শৈশব। 


বিজ্ঞাপন


চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিট থেকে পাশ করেছেন তুষ্টি। পেশায় একজন ডেন্টাল সার্জন তিনি। পাশাপাশি অনলাইন ব্যবসায়ীও। সংসার, ডাক্তারি পেশা, ব্যবসা সব সামলাচ্ছেন সমান তালে। ডাক্তার হওয়ার বিষয়টি নাহয় জানা গেল। কিন্তু ব্যবসায়ী খাতায় কীভাবে নাম লেখালেন? 

tushtiব্যবসায়ী হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে তুষ্টি বলেন, ‘একদম হুজুগে ব্যবসায় আসা। ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষার পর খুব অলস সময় কাটাচ্ছিলাম। ছাত্রী পড়ানো ছাড়া সারাদিনে আর কোনো কাজ নেই। সময় কাটাতে শখের রান্নাবান্না করতাম। তাও যেন সময় ফুরাত না। টুকটাক ক্রাফটিং করতাম। হোস্টেলের সিনিয়র জুনিয়ররা খুব সাধুবাদ জানাল। কাস্টমাইজড হিজাব পিন, ব্রোচ, হেয়ারব্যান্ড বানাতাম।’ 

‘একদিন মনে হলো শখের কাজটিই ব্যবসায়িকভাবে শুরু করি। সেই থেকে শুরু। ডাক্তার হয়ে যাবার পর আর সময় করে উঠতে পারলাম না। ক্রাফটিং ছাড়তে হলো। তবে ব্যবসাটা ছাড়লাম না। কসমেটিকস, স্কিন অ্যান্ড হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ শুরু করলাম। ছোট একটা ফেব্রিকের পেইজও আছে।’- যোগ করেন তুষ্টি। 

তুষ্টির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম এস্টিলো। ডাক্তার হওয়ার আগেই ব্যবসায়ী হিসেবে নাম লেখান এই নারী। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ব্যবসায়িক জীবনের সূচনা। বাঁধাধরা কোনো পণ্য বিক্রি করেন না তিনি। তুষ্টি বলেন, ‘কসমেটিকস, ত্বক ও চুল সম্পর্কিত পণ্য নিয়ে কাজ করি। মেকআপ একসেসরি, স্টাইল রিলেটেড যেকোনো পণ্য চাহিদা অনুযায়ী ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করি।’


বিজ্ঞাপন


tushtiউদাহরণ হিসেবে জানালেন বৃষ্টিতে ব্যবহারের ট্রান্সপারেন্ট ছাতার কথা। বেশ সাড়া জাগিয়েছিলেন এই পণ্যটি বিক্রি করে। আবার করোনার সময় যখন নকল পণ্যে বাজার সয়লাব হয়েছিল, তখন চেষ্টা করেছেন একটু বেশি দামের পণ্য হলেও ক্রেতার কাছে যেন অথেনটিক পণ্য পৌঁছানো যায়। বছরজুড়ে প্রোফাইবার হেয়ার মাস্ক, শীতের পা ফাটা রোধে বানানা ফুট ক্রিম ইত্যাদির চাহিদা থাকে শীর্ষে। 

করোনা কেমন প্রভাব ফেলেছে ব্যবসায়? জানতে চাওয়া হলে তুষ্টি বলেন, ‘সত্যি বলতে আমার ব্যবসাতে করোনার প্রভাব ইতিবাচক ছিল। করোনার শুরুতে একদম হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম। এই করোনায় কে আর কসমেটিকস কিনবে? নিজে পেশায় ডাক্তার। দেখলাম চারিদিকে সুরক্ষা সামগ্রী যেমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হেক্সিসল, সার্জিক্যাল মাস্ক, কে এন ৯৫ মাস্ক, অক্সিমিটার এইসব কিছুর হাহাকার। আকাশচুম্বী দাম আর নকল জিনিসের ছড়াছড়ি। এরপর করোনার মধ্যেও আমি আর আমার স্বামী এসব জিনিসের সোর্সিং শুরু করলাম।’

‘প্রথমদিকে সবকিছুর দাম অনেক বেশি ছিল, চেষ্টা করেছিলাম দাম বেশি হোক তবু আসল জিনিস ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিতে। আস্তে আস্তে নাগালের মধ্যে ভাল জিনিস পেয়ে গেলাম। মানুষের অসাধারণ রেসপন্স পেলাম, বিশ্বস্ততার মূল্য পেলাম। করোনা আমার ব্যবসার ক্ষতি তো করলোই না, বরং আল্লাহ ভীষণ বরকত দিলেন আলহামদুলিল্লাহ্।’- যোগ করেন তিনি। 

tushtiক্রেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে তুষ্টির। তিনি মনে করেন, ক্রেতার সম্পূর্ণ অধিকার আছে কেনার আগে যাচাই বাছাই করে নেয়ার। ক্রেতাতে যেকোনো পণ্য সম্পর্কে পূর্ণ বিবরণ দেয়াটা খুব জরুরী। সবমিলিয়ে এত বছরের ব্যবসা জীবনে ক্রেতার সঙ্গে অভিজ্ঞতার খাতায় ভালো অনুভূতিই বেশি জমিয়েছেন তিনি। 

কাজের শুরু থেকেই পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন তুষ্টি। পরিবারের সদস্যরা তার থেকেই নানা পণ্য কিনতেন, এখনও কেনেন। মা-বাবা গর্ব করে বলেন মেয়ের ব্যবসা করা কথা। তুষ্টি বলেন, ‘আগে বাবা-মা, খালাদের সহযোগিতা পেয়েছি। বিয়ের পর স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির মানুষদের থেকেও উৎসাহ পেয়েছি। এখন আমার চেয়ে আমার স্বামীরই বেশি মায়া আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে। তবে দুই একজন মানুষের বাঁকা কথা যে শুনিনি তা না। অনেকেই বলেছেন, ‘ডাক্তারি না করে এসব করবা’। এই দুই একজনের কটু কথাতে আমার কিছু যায় আসেনি। কারণ মেডিকেলের সিনিয়র, জুনিয়র, পরিবার সবার উৎসাহ ছিল আমার সঙ্গে। 

অনেকবার থেমে যাওয়ার কথা ভেবেছেন এই নারী উদ্যোক্তা। তুষ্টি বলেন, মাঝে মাঝে ডাক্তারি, ব্যবসা, সংসার সবকিছুর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হাঁপিয়ে উঠি। অনেকবার মনে হয়েছে আর পারছি না। তবে যতবার এমন মনে হয়েছে, নিজের মনকে বোঝাতে হয়নি.... আমার স্বামীই বার বার আমাকে বুঝিয়েছে “তুমি থেমে গেলে হবে না, তুমি পারবে”। 

একদিকে ডাক্তারি পেশা, অন্যদিকে ব্যবসা। সঙ্গে আছে সংসার। কীভাবে সামলান সব? জানতে চাওয়া হলে তুষ্টি বলেন, ‘আমার যেহেতু পারসোনাল প্র‍্যাকটিস আর ডেন্টালের চেম্বার তাই সাধারণত বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত মূল পেশায় ব্যস্ত থাকি। যখন প্র‍্যাকটিস করি সারাদিন ব্যবসার কাজ, বিকালের পরে ডেন্ট্রিস্ট্রি এরপর আবার সংসার... মাঝেমধ্যে ক্লান্তি লাগে ঠিকই। কিন্তু কেন যেন খারাপ লাগে না। কীভাবে যেন ব্যালেন্স হয়ে যায়। আমি এখনো পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশনে ঢুকিনি, সন্তানও নেই। ভবিষ্যতে কীভাবে সামলাবো জানি না, আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবেনই ইন শা আল্লাহ।’

tushtiতুষ্টির মতে, ব্যবসাতে নিজস্বতা থাকা জরুরি, সবার রিজিক নির্দিষ্ট, অন্যের ক্ষতি করে বিজনেস খুব বেশিদূর আগায় না। অভিমানের স্বরে তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে খারাপ লাগে যখন দেখি, নতুন নতুন পেইজ বা গ্রুপগুলোর নিজস্বতা নেই। প্রোডাক্ট আনার ক্ষেত্রে সবসময় অন্যকে ফলো করে, অন্যের বিজনেস নষ্ট করার একটা সূক্ষ্ম প্রয়াস থাকে। এই ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগে।’ 

ভবিষ্যতে আরও ভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করতে চান তুষ্টি। ফেব্রিক নিয়ে আলাদা কাজ শুরু করেছেন। নিজস্ব কারিগরের মাধ্যমে কাঠ বা বোর্ডের কিছু অনুষঙ্গ নিয়েও কাজ করতে চান তিনি। থাইল্যান্ড এবং কোরিয়ান ব্র্যান্ড নিয়ে কাজের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। 

একদিন এস্টিলো নিজেই বিভিন্ন দেশ থেকে কারও সাহায্য ছাড়া নিজেই প্রোডাক্ট আমদানি করবে এই স্বপ্ন দেখেন তুষ্টি।  

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর