সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে মুনের ক্যালিগ্রাফি আঁকা 

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ২০ জুলাই ২০২২, ০২:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে মুনের ক্যালিগ্রাফি আঁকা 

ক্যালিগ্রাফি শব্দটির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত না হলেও চারুলিপি বা হস্তলিপি শিল্পের নাম শুনেছেন হয়তো। চেনাজানা সহজ ভাষাকে শৈল্পিকভাবে লিখে প্রকাশ করার যে প্রক্রিয়া সেটিই ক্যালিগ্রাফি। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, জাপানিসহ নানা ভাষার ক্যালিগ্রাফি হয়। তবে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় আরবি ভাষার ক্যালিগ্রাফি।

বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে অল্প কিছু মানুষ জড়িত আছেন। তবে দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ায় এই ক্ষেত্রটি যুক্ত হচ্ছেন অনেক তরুণ। নিজের আঁকার প্রতিভাকে রূপ দিচ্ছেন শিল্পে। ক্যালিগ্রাফি বিক্রির মাধ্যমে হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। এমনই একজন তরুণ মুনতাসির হক মুন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ক্যালিগ্রাফার হিসেবে নিজের পরিচয় দাঁড় করিয়েছেন। পেয়েছেন অগণিত মানুষের প্রশংসা। কীভাবে তিনি ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত হলেন? উদ্যোক্তা হওয়ার পথ কেমন ছিল? 


বিজ্ঞাপন


মুনের জন্ম কুমিল্লাতে। তবে বেড়ে ওঠা সুনামগঞ্জের ট্যাকের ঘাটে। সেখানেই ছেলেবেলা কাটিয়েছেন তিনি। দুরন্ত এক শৈশব কাটিয়েছেন মুন। পর্যটন এলাকা হওয়ায় সেখানে মাঠ, ঘাট, স্কুল, পাহাড় সবই ছিল। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরা কিংবা পাহাড় বয়ে যাওয়া পানির ধারা দেখার স্মৃতিগুলো এখনো অম্লান হয়ে আছে তার কল্পনায়। 

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শেষ করে মাদরাসায় ভর্তি হন মুন। হয়েছেন কোরআনে হাফেজ। এরপর ৬ বছরের বিরতি। তারপর আবার ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সাধারণ পড়াশোনা শুরু করেন। অর্থনীতি থেকে সম্প্রতি স্নাতক শেষ করেছেন। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে মুন জানান, মাদরাসায় একদমই মন টিকত না তার। শুরুর দিকে খুব কান্নাকাটি করতেন। বোর্ডিংয়ের দিনগুলো ছিল কষ্টের। ছুটিতে বাড়িতে গেলে পরিবার ছেড়ে আর আসতে মন চাইতো না। 

calligraphyছেলেবেলার স্মৃতি বলতে গিয়ে মুন বলেন, ‘তখন বয়স ৯/১০ হবে। মা আমাকে নিজেই এসে দিয়ে যাচ্ছিলেন ট্যাকের ঘাট থেকে ঢাকায়। কিন্তু আসার পথে আমাদের নৌকা ডুবে যাবে যাবে এমন অবস্থায় ছিল। ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম আমরা। সেদিন মাকে জড়িয়ে কান্না করছিলাম। সঙ্গে ছোট ভাইও ছিল। মা শুধু আল্লাহকে ডাকছিলেন বারবার। সে যাত্রায় আল্লাহ বাঁচিয়েছিলেন আমাদের। এখনও সেই দিনের কথা মনে পড়ে।’

বর্তমানে মুনের সময় কাটে ক্যালিগ্রাফি আঁকাআঁকির মাধ্যমে। এর পাশাপাশি সময় পেলে কুরআন শিক্ষা দিয়ে থাকেন। ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কীভাবে জানতে চাই তার কাছে। মুন জানান, শুরুটা ছিল শখের বসেই। আস্তে আস্তে তা পেশা হয়ে যায়। বাড়ে দায়িত্ব। বাবাকে হারানোর পর ছেলে হিসেবে পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে চলে আসে। মূলত বাবাহীন পরিবারের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়ার লক্ষ্যেই ক্যালিগ্রাফি বিক্রির মাধ্যমে উদ্যোক্তাজীবন শুরু করেন এই তরুণ। 


বিজ্ঞাপন


মুন বলেন, ‘সকালে ক্লাস শেষ করে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত টিউশন করতাম। সেখান থেকে ফিরে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে বসতাম। সারারাত বা মধ্যরাত পর্যন্ত চলত কাজ। এভাবেই দিন চলছিল। একদিন ছোট ভাই বলল একটা পেইজ খুলে যেন অল্প দামে হলেও ক্যালিগ্রাফি বিক্রি করি। যেহেতু এর সময় যেতো, পরিশ্রম হতো। আর মানুষ পছন্দ করতো কাজটা। এভাবে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে ব্যবসায়িক জীবনের শুরু।’

নিজের নাম আর কাজ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম নির্ধারণ করেছেন তিনি। ‘মুন ক্যালিগ্রাফি’ নামের অনলাইন প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালের মার্চে। আরবি ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাজ করেন মুন। আরবি হরফ কিংবা কুরআন ও হাদিসের সুন্দর সুন্দর বাণী, আয়াত বা সূরাসমুহ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কখনো কখনো আরবি নামেরও কাজ করেন। অর্থাৎ, আরবি সম্পর্কিত সব ধরনের ক্যালিগ্রাফি নিয়েই কাজ করেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। আঁকার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন বিশেষ কাগজ, ক্যানভাস, রঙ আর তুলি। 

calligraphyএকই ধরনের কাজ করছেন আরও অনেকে। মানুষ কেন মুন ক্যালিগ্রাফিকে আলাদা করে মূল্যায়ন করবে? জানতে চাওয়া হলে মুন বলেন, ‘আমি সবসময় আমার কাজের ধরন আলাদা রাখার চেষ্টা করি। নিজস্বতা বলা চলে। কাজ করতে করতে এখন যারা আমার কাজ দেখে আলহামদুলিল্লাহ তারা কাজ দেখেই বুঝে ফেলে আমার কাজ। কাজের ক্ষেত্রে নিজস্বতা কিংবা কালার মিক্সিং বা কাজের ধরনেই আমার কাজ অন্যদের কাছে ভিন্নতা প্রকাশ পায়।

‘গত ৪ বছর ধরে কাজ করে যে জিনিস বুঝেছি তা হলো ক্রেতা সুন্দর কিছু চায় তার মনের মতো। যেটা তার মনের ক্যানভাসকে জাগিয়ে তুলবে। তাছাড়া আরেকটা বিষয় হচ্ছে বিশ্বস্ততা। এটা অন্যতম একটা জিনিস যা অত্যন্ত আবশ্যকীয়। এই বিশ্বস্ত শব্দটা আপনার কিংবা আপনার কাজ- উভয়ের প্রতি এই মনসংযোগ থাকলে ক্রেতা কখনো পিছু ছাড়েন না। তাছাড়া রিযিকের মালিক আল্লাহ। তিনি তো আছেনই।’- যোগ করেন মুন।

ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে আশীর্বাদ মনে করেন এই উদ্যোক্তা। মুন বলেন, ‘দুজনের সমন্বয় অবশ্যই জরুরি একটি বিষয়। প্রকৃতপক্ষে সবাই আমরা নিজের দিকটাই ভাল বুঝি। হোক ক্রেতা বা বিক্রেতা! আমার ক্ষেত্রে যেটা চেষ্টা করি তা হলো নমনীয়ভাবে কথা বলে যতটুকু সম্ভব তাকে খুশি করা। অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতা সুন্দর আচরণেও খুশি হয়ে যান।’

ব্যবসা করতে গিয়ে নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে মুনের। কিছু কষ্টের হলেও বেশিরভাগই আনন্দের। নিজের পণ্য নিজেই ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। অর্থাৎ ঢাকার ভেতরে মুনই ডেলিভারি ম্যান। তাই অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমে নানা অনুভূতি। 

calligraphyকাজের সূত্রে সুন্দর স্মৃতি বর্ণনা করে মুন বলেন, ‘একদিন একজন ভাইয়া আমাকে একটি ক্যালিগ্রাফি অর্ডার করেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে। ভাইয়ার বোনকে বিয়ে উপলক্ষে উপহার দেবেন। সময় দিয়েছিলেন ৩/৪ দিন। কিন্তু ক্যালিগ্রাফিটা বড় হওয়ায় তা সম্ভব ছিল না। আরও অর্ডার থাকায় তা সিরিয়াল অনুযায়ী করতেও পারছিলাম না। আমি বলেছিলাম কথা দিতে পারছি না। তবে ইন শা আল্লাহ চেষ্টা করতে পারি।’

‘এর মাঝে একদিন পরীক্ষাও ছিল। তারপর মনে মনে ভাবলাম নাহ, ভাইয়াকে একটা সারপ্রাইজ দিই!  বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে শুক্রবার ৫টা ৩০ পর্যন্ত টানা ১৭ ঘণ্টা+ কাজ করেছি। মাঝে একবেলা খেয়েছি আর নামাজ! কাজ শেষ করে আমি ৬টার বাসে চড়ে রওনা দিলাম চট্টগ্রাম। কেননা কুরিয়ারে দিলেও অন্তত একদিন লাগবে পৌঁছাতে। কিন্তু বিয়ে শুক্রবার আর সেদিন না হলে হবে না। তাই যেই ভাবা সেই কাজ! আমি গাড়িতে ওঠার আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম ১টার আগে পৌঁছানো সম্ভব কিনা। আমাকে বলল আপনি ১২ টায় পোঁছে যাবেন। আমি ১২:৩০টায় চট্টগ্রাম নামি এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে যাই। সবাই অবাক হয়ে যান। তারা এত খুশি হয়েছিল! আলহামদুলিল্লাহ। এমন পাগলামি করি কখনো কখনো।’- যোগ করেন মুন। 

পথ চলাটা শুরুর দিকে পুরোপুরি মসৃণ ছিল না মুনের। পাননি পরিবারের সমর্থন। সবাই বকাঝকা করতেন। বাধা দেওয়া হতো কাজে। কাজের ছবি তোলার জন্য প্রয়োজন একটি ভালো ক্যামেরার ফোন। সেটিও ছিল না তার। তবে বর্তমানে সবাই উৎসাহ দেন তাকে। 

calligraphyমুন বলেন, ‘মা ও খুশি এখন এই কাজে। আগে মা বেশি বকাঝকা করতেন। এখন তিনিই আমার কাজে হাত বুলিয়ে কান্না করেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। স্রষ্টার কাছে এটিই আমার বড় পাওয়া।’

কাজ করতে করতে দেহ মনে ক্লান্তি আসে। জীবনের নানা ছোট-বড় জটিলতা মনকে বিষণ্ণ করে। প্রায়ই মুন ভাবেন, অনেক হয়েছে। আর কাজ করবেন না। কিন্তু আবার নিজেই নিজেকে বুঝান। কারণ তার ওপর পরিবারের দায়িত্ব। তাকে পারতেই হবে। থেমে গেলে চলবে না। তাছাড়া আয়হীন জীবনযাপন করাও কঠিন। 

ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে যে কেবল ব্যবসা করছেন মুন তা নয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছে। ২০২১ সালে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সম্মাননা পেয়েছিলেন তিনি। সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন জাতীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েও। 
 
অনেকেই ক্যালিগ্রাফি শিল্পে আগ্রহী হচ্ছেন। তাদের উদ্দেশে মুন বলেন, ‘আমার পরামর্শ থাকবে কাজের পিছনে পরিশ্রম ও সময় দেওয়া। কেননা কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। সততা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বাস তৈরি করতে হবে। নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস রাখলে আর নতুনত্ব আনার চেষ্টা করলে অনেকদূর আগানো সম্ভব।’

calligraphyস্বপ্ন দেখতে ভয় পান মুন। ভয় হয় যদি সেই স্বপ্ন পূরণ না হয়। তবু মানুষ মাত্রই স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে মুন বলেন, ‘আমি চাই আল্লাহর বাণী ছড়িয়ে দিতে দেশ দেশান্তরে কিংবা দেশের বাহিরে। সবাই মুন ও মুন ক্যালিগ্রাফিকে চিনুক ও জানুক। কাজের সীমানা বা মাধ্যমকে আরেকটু বড় করার ইচ্ছে আছে। উদ্যোগ নিয়েছি। চেষ্টা করছি কাজের পিছনে সময় দিতে। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছে।’

ক্যালিগ্রাফিতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না মুনের। দিনের পর দিন এই বিষয় নিয়ে অনুশীলন করেছেন তিনি। কোন রঙের ওপর কোন রঙ মানাবে, কীভাবে লেখা আরও আকর্ষণীয় করা যাবে- তা নিয়ে ভেবেছেন, কাজ করেছেন। রাত ভোর করেছেন কাজ করতে করতে। পরিবারের জন্য এখনও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন এই তরুণ।  

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর