ক্যালেন্ডারের পাতায় ডিসেম্বর কেবল একটি নাম নয়, এটি একটি অনুভূতি। সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে যখন বছরের শেষ প্রান্তে এসে থামে, তখন শহরটা হুট করেই বদলে যায়। অন্য এগারোটি মাস যেমন নিছক দিনযাপনের, ডিসেম্বর তেমন নয়। এটি যেন স্মৃতির জমাট বাঁধাই করা বাক্স, নরম বিষাদের মিহি পর্দায় ঢাকা এক মায়াবী শহর। বছর শেষের এই সময়টাতে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের মন— সবই এক অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা পড়ে।
ডিসেম্বর এলেই চেনা শহরের রঙ আচমকা বদলে যেতে থাকে। কুয়াশায় মোড়া ধোঁয়াশাচ্ছন্ন সকাল, বিকেলের আকাশে দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া নরম সোনালি আলো আর সন্ধ্যা নামলেই হরেক রঙের বাতির উৎসব—সব মিলিয়ে শহরটা হয়ে ওঠে কোনো এক নীরব আয়োজনের মঞ্চ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলে থাকা রঙিন আলোকসজ্জা, বিপণিবিতানগুলোর কাচে শীতের পোশাকের জমকালো প্রদর্শনী, আর ক্যাফের ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই ভেসে আসা কড়া কফির ঘ্রাণ— সব মিলিয়ে শহর তখন উৎসবমুখর। তবু, এই উৎসবের আড়ালে কোথায় যেন এক গভীর একাকিত্ব লুকিয়ে থাকে। জাঁকজমকপূর্ণ এই শহরে ভিড়ের মাঝেও মানুষ একা, ভীষণ একা।
বিজ্ঞাপন
ডিসেম্বর এক অদ্ভুত দ্বান্দ্বিক মাস; এখানে আলো ও অন্ধকার পাশাপাশি হাঁটে। একদিকে ‘থার্টি ফার্স্ট’ বা বড়দিন ঘিরে উৎসবের তোড়জোড়, অন্যদিকে বছর ফুরিয়ে যাওয়ার হাহাকার। সারা বছর জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত নাগরিকেরা রাতে নিয়নের আলোয় হয়তো ঝলমল করে ওঠে, কিন্তু তাদের বুকের ভেতর ভাঙনের শব্দ কি কেউ শুনতে পায়? অফিসের ‘ইয়ার এন্ডিং’ এর ব্যস্ততায় ডুবে থাকা মানুষটি যখন ট্রাফিক জ্যামে আটকে জানালার কাচে মাথা রাখে, তখন তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।

আমাদের এই জনপদে ডিসেম্বর নিছক শীতের মাস নয়; এটি একই সঙ্গে স্মৃতি, বিজয় এবং উপলব্ধির মাস। জাতীয় জীবনে যেমন এটি বিজয়ের উল্লাস নিয়ে আসে, লাল-সবুজের পতাকায় মোড়ানো থাকে রাজপথ; তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে এটি নিয়ে আসে পুরনো খাতার ধুলো ঝেড়ে দেখার অবসর।
শীতের অলস দুপুরে জানালার গ্রিল গলে এক চিলতে রোদ যখন বিছানায় এসে পড়ে, তখন অনেকেরই অবচেতনে মনে পড়ে যায় এমন কারও কথা, যাকে একসময় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হতো। হয়তো কোনো এক ডিসেম্বরেই তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, কিংবা কোনো এক কুয়াশাঘেরা সন্ধ্যায় হয়েছিল শেষ কথা।
বিজ্ঞাপন
শহরটা যতই চেনা থাকুক—সেই চেনা ট্রাফিক সিগন্যাল, চেনা রিকশার হুড, চেনা চায়ের দোকান— মানুষের ভেতরের গল্পগুলো কিন্তু প্রতি বছরই বদলে যায়। গত ডিসেম্বরে যে মানুষটি পাশে ছিল, এই ডিসেম্বরে হয়তো সে যোজন যোজন দূরে। অপ্রাপ্তিগুলো পূরণের তীব্র ইচ্ছে জাগে, কিন্তু বছর শেষে দেখা যায় প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির তালিকাই দীর্ঘ হয়েছে।

এই মাসে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে মানুষের মুখোশ। উৎসবের এই মরসুমে কেউ সাজানো হাসির আড়ালে গভীর ক্লান্তি চাপা দিয়ে রাখে; কেউবা মৃতপ্রায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চালিয়ে যায় এক নীরব যুদ্ধ। আবার কেউ এই শহরে সশরীরে উপস্থিত থেকেও মনে মনে হাঁটতে থাকে অন্য কোনো শহরের পথে, যেখানে তার প্রিয় মানুষ বা প্রিয় সময় ফেলে এসেছে।
ডিসেম্বর মানুষকে অজান্তেই খানিকটা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ করে তোলে। এটি এক ধরনের নরম, ভঙ্গুর সময়। কুয়াশা যত ঘন হয়, স্মৃতির ক্যানভাস তত পরিষ্কার হতে থাকে। যান্ত্রিক শহর মানুষকে কেবল ছুটতে শেখায়, থামতে দেয় না। তাই এখানে প্রকাশ্যে কাউকে কাঁদতে দেখার সময় কারও নেই। ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, দীর্ঘশ্বাস আর চোখের কোণের জল মানুষের ভিড়ের মধ্যেই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়; এটাই তো এই শহরের অলিখিত নিয়ম।
তবুও, সব হাহাকার ছাপিয়ে ডিসেম্বরের বাতাসে ছড়িয়ে থাকে ভালোবাসার নানান গল্প। শীতের তীব্রতায় উষ্ণতা খুঁজতেই মানুষ একে অপরের কাছে আসে। শহরের সোডিয়াম বাতির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ-তরুণী হয়তো এই ভঙ্গুরতার মাঝেও বিশ্বাস করতে চায়—ভালোবাসা টিকে আছে, টিকে থাকবে।

পোর্সেলিন বা চিনামাটির পাত্র যেমন পরম যত্নে রাখলে আজীবন নতুনের মতো থেকে যায়, সম্পর্কও ঠিক তেমনই। পারস্পরিক বোঝাপড়া, সময় আর উষ্ণতার যত্নে সম্পর্ক টিকে থাকে। ডিসেম্বরের কুয়াশা হয়তো অনেক কিছু আড়াল করে, কিন্তু হৃদয়ের সত্য লুকাতে পারে না—ভালোবাসা ভঙ্গুর, কিন্তু একবার টিকে গেলে তা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও টেকসই জিনিস।
ডিসেম্বর যেন নিজের সঙ্গে নিজের ‘হালখাতা’ মেলানোর সময়। তবে এই হিসেব সবসময় লাভ-ক্ষতির অঙ্কে মেলে না। কখনো কখনো নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। বুঝে নিতে হয়—যে হাতটি ধরে রাখা ছিল সবচেয়ে সহজ, তাকেই ধরে রাখতে হয়েছে সবচেয়ে কঠিনভাবে। যে শহরটাকে নিজের সবচেয়ে আপন আশ্রয় বলে মনে হয়েছিল, সেখানেই কোনো এক মুহূর্তে নিজেকেই সবচেয়ে বড় আগন্তুক মনে হয়।
ডিসেম্বরের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো এর দ্বৈত সত্তা। এটি একইসঙ্গে বিদায় ও সম্ভাবনার মাস। একদিকে ঝরা পাতার মতো ঝরে যাওয়া পুরনো বছর, অন্যদিকে নতুন ক্যালেন্ডারের অপেক্ষা। পুরনো বছরের জরা, ব্যথা ও গ্লানি আর নতুন বছরের আশা—এই দুইয়ের মিশেলে তৈরি হয় এক অদ্ভুত ধূসর সময়।
সেই সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আবার পরমুহূর্তেই বুক ভরে শ্বাস নেয় নতুন শুরুর আশায়। কুয়াশা কেটে গেলে যেমন রোদ ওঠে, তেমনি ডিসেম্বরের বিদায়ের পরেই আসে জানুয়ারির নতুন ভোর।

