রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সাইমা বিভার দীপ্ত পদচারণা

তানজিদ শুভ্র
প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:০৮ পিএম

শেয়ার করুন:

সাইমা বিভার দীপ্ত পদচারণা

যান্ত্রিক এই নগরে মানুষের আবেগ যখন ক্রমশ যান্ত্রিকতায় রূপ নিচ্ছে, ঠিক তখনই কিছু তরুণ প্রাণ নিজেদের মেধা আর মনন দিয়ে আগলে রাখছেন আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য আর শুদ্ধতার চর্চা। কেউ কাদামাটি দিয়ে গড়েন দৃশ্যমান অবয়ব, কেউ রং-তুলিতে ক্যানভাস রাঙান আর কেউবা শব্দের বুননে আঁকেন অদৃশ্য ছবি। কিন্তু যখন একই মানুষের হাতে এসব শিল্পের মিলন ঘটে, তখন সৃষ্টি হয় এক অনন্য জাদুকরী ব্যক্তিত্বের। তেমনই এক প্রতিভাবান তরুণীর নাম সাইমা বিভা। যিনি একাধারে মৃৎশিল্পী, কলমযোদ্ধা এবং বাচিক শিল্পী। লেখালেখির নিঃশব্দ ভুবন, ভাস্কর্যের ধ্রুপদী রূপ আর আবৃত্তির সরব ও ছন্দময় জগত সব ক্ষেত্রেই তার বিচরণ সমান সাবলীল ও নান্দনিক।

সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার স্নিগ্ধ পরিবেশে, এক ডিসেম্বরের হিমমাখা ১৪ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন মোছা. সাইমা আক্তার বিভা। তার বেড়ে ওঠা এক মধ্যবিত্ত শিক্ষানুরাগী পরিবারে। বাবা মরহুম এ. কে. এম আলী আক্তার ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। আমৃত্যু তিনি মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে মা মোছা. মুর্শিদা লায়লা একজন কর্মজীবী নারী। বাবার আদর্শিক সততা আর মায়ের কর্মস্পৃহা এই দুইয়ের ছায়ায় ক্রমশ বিকশিত হয়েছে বিভার মানসজগৎ। 


বিজ্ঞাপন


biva1

সরকারি আকবর আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সাইমা বিভা বর্তমানে অধ্যয়ন করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য’ বিভাগে। মতিহারের সবুজ চত্বর তার মননচর্চা, শিল্পবোধ ও কাব্যিক উচ্চারণের বিকাশে রেখেছে অনন্য ভূমিকা। শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি; পড়াশোনার পাশাপাশি নেতৃত্বের গুণাবলিতেও তিনি উজ্জ্বল। বর্তমানে তিনি ‘বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম’-এর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সাইমা বিভার আবৃত্তিজীবনের শুরুটা হয়েছিল সেই শৈশবেই। তবে সময়ের পরিক্রমায় সেই কচি কণ্ঠ আজ পরিণত, গভীর এবং আবেগময়। তিনি প্রমাণ করেছেন, আবৃত্তি কেবল বই দেখে পাঠ করা নয়; বরং এটি চিন্তার গভীরতা প্রকাশের একটি শিল্প, শব্দের পিঠে শব্দ সাজিয়ে অদৃশ্য দৃশ্যপট তৈরির কারিগরি। তার কণ্ঠের জাদুকরী স্পর্শে কবিতাগুলো যেন প্রাণ পায়। কখনো দ্রোহের আগুন, কখনো প্রেমের স্নিগ্ধতা, আবার কখনো বা বিষাদের ছায়া-সবই তিনি ফুটিয়ে তোলেন অত্যন্ত নিপুণতায়। 

092ad1b0-0e51-4f69-a252-b1875c57337e


বিজ্ঞাপন


শুধু আবৃত্তি নয়, ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবেও তিনি কাজ করছেন দাপটের সঙ্গে। রংপুরের জনপ্রিয় অনলাইন মিডিয়া ‘আপডেট টিভি’-র ভিডিও কন্টেন্টে নিয়মিত শোনা যায় তার ভরাট কণ্ঠস্বর। এছাড়াও বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ডকুমেন্টারি ও বিজ্ঞাপনে তার কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

প্রযুক্তির এই যুগে সাইমা বিভা নিজেকে কেবল মঞ্চ বা প্রথাগত মাধ্যমের মধ্যে আটকে রাখেননি। তার সৃজনশীল কাজগুলো এখন ছড়িয়ে পড়েছে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। ফেসবুক ও ইউটিউবের গণ্ডি পেরিয়ে তার আবৃত্তি ও অডিও কন্টেন্ট জায়গা করে নিয়েছে স্পটিফাই, অ্যামাজন মিউজিক-এর মতো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়ে তিনি নিজের বহুমাত্রিকতা ও কণ্ঠনির্ভর শিল্পপ্রেমকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। শব্দ, সুর, ব্যঞ্জনা আর নিঃশব্দ বিরতির সমন্বয়ে বিভা গড়ে তুলেছেন আবৃত্তির এক নিজস্ব ঘরানা, যা শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।

35c4ee3a-d4f9-47c6-ada7-7e9b4666bfe7

কণ্ঠের পাশাপাশি কলমও তার অন্যতম হাতিয়ার। লেখালেখিতে সাইমা বিভার হাতেখড়ি হয়েছিল ‘কিশোর মঞ্চ’ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে। সেই যে শুরু, এরপর আর থামেননি। একসময় ‘দৈনিক আলোকিত সকাল’-এ প্রদায়ক হিসেবে নিয়মিত লিখেছেন। এরপর প্রথম আলো, ইত্তেফাক, জাগো নিউজ সহ প্রথম সাড়ির পত্র পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। সমাজের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ তার প্রতিটি কলাম ও সৃজনশীল লেখায় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

সাইমা বিভা বিশ্বাস করেন, শিল্প কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তিনি শব্দে শব্দে গড়ে তুলছেন নিজের এক স্বতন্ত্র পরিচয়। তার এই যাত্রা কেবল একজন শিল্পীর নয়, বরং মফস্বল থেকে উঠে আসা এক তরুণীর লড়াই, বেড়ে ওঠা এবং আত্মপ্রকাশের গল্প। যিনি তথাকথিত ভাইরালের স্রোতে গা না ভাসিয়ে, শুদ্ধ উচ্চারণের অনুরণনে পাঠক আর শ্রোতার হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়তে চান।

সাহস, সাধনা আর সংবেদনশীলতার অনন্য সংমিশ্রণ সাইমা বিভা। আগামী দিনের বাংলা সংস্কৃতি অঙ্গনে তার এই দীপ্ত পদচারণা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠুক, তার কণ্ঠস্বর ও লেখনী হয়ে উঠুক হাজারো তরুণের প্রেরণা এমনটাই প্রত্যাশা তার শুভানুধ্যায়ীদের।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর