আজ হঠাৎ আক্কাস আলীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কোনো বিশেষ দিন, কোনো বিশেষ ঘটনার জন্য নয়, বরং এমন এক ধরনের শূন্যতার কারণে, যেটা মাঝে মাঝে অতীতের কোনো মানুষকে হঠাৎ খুব কাছে টেনে আনে। সেদিন অমাবস্যা ছিল না। আকাশে চাঁদ ছিল, বাতাসও শান্ত ছিল। তবু সেই স্বাভাবিক দিনের ভেতর থেকেই আক্কাস আলী হারিয়ে গেল। কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই, কোনো শব্দ ছাড়াই, সে নিঃশব্দে সমাজের ভিড় থেকে সরে গেল।
হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু শারীরিক অনুপস্থিতি নয়। মানে হলো হঠাৎ একদিন তার চারপাশের মানুষরা তাকে ভুলে গেল। সে আর কোনো আড্ডায় ডাক পেল না, বাড়ির পুরনো উঠোনে কেউ তাকে বসতে বলল না। একসময়কার হাসিমাখা চেহারাটা ভাঙা ভাঙা হয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল। যেন সমাজ তাকে সাবধানে বা কোমলভাবে সরিয়ে দেয়নি, বরং ঠান্ডা, অমোঘভাবে একপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আক্কাস আলী একজন প্রতিবন্ধী। কিন্তু সমাজ তার নামের সঙ্গে এই পরিচয়টি এত দৃঢ়ভাবে জুড়ে দিয়েছে যে বাকি সব পরিচয় চাপা পড়ে গেছে। তার ইচ্ছা ছিল স্বাভাবিকভাবে বাঁচার, নিজের চেষ্টা, দক্ষতা, শ্রম দিয়ে মানুষ তাকে চিনবে। কিন্তু সে পারেনি। বা বলা ভালো, তাকে পারতে দেওয়া হয়নি। সমাজ তাকে শিখিয়েছে, তুমি করুণার পাত্র। তুমি স্বাভাবিক নও। তোমাকে সাহায্য করা মানেই উপকার করা। এই বার্তাই তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।

একজন মানুষ যদি পাশে দাঁড়াত এবং বলত, ‘তুমি পারবে’, জীবনটি পরিবর্তন হতে পারত। ভালোবাসা মানে প্রতিবন্ধী মানুষকে ‘অসামান্য’ বানানো নয়, বরং তাকে সমান মর্যাদায় দেখা।
আক্কাস আলীর জীবনে যদি এমন একজন মানুষ থাকত, যে প্রতিদিন বলত, ‘তুমি কোনো বোঝা নও, তুমি নিজের মতো করে পূর্ণ,’ তাহলে হয়তো সে হারিয়ে যেত না, নিঃশব্দে ভেঙে পড়ত না। কিন্তু একবার তার ভালোবাসার মানুষ বলেছিল, ‘তুমি এটা করো, আমি তোমার সঙ্গে আছি।’ কিন্তু সেই ভালোবাসার মানুষটি পাশে দাঁড়ায়নি। দায়িত্ববোধের কারণে সে অন্যদিকে চলে গেল।
বিজ্ঞাপন
গভীর রাতে বা ভোরবেলায় তাকে দেখা যেত হাঁটার চেষ্টা করতে, কাজ করার চেষ্টা করতে। কিন্তু সমাজের দৃষ্টিটা সবসময় তার দিকে করুণায় ভেজা ছিল। সেই করুণা শক্তির জায়গায় দাঁড়াতে দেয় না, বরং মানুষকে আরও ছোট করে ফেলে।

গ্রামসি বলেছেন, সমাজ যেসব আচরণকে বারবার চর্চা করে, সেগুলোই শেষ পর্যন্ত সামাজিক সত্যে পরিণত হয়। আমাদের সমাজ প্রতিবন্ধীদের প্রতি করুণাকে এত বেশি চর্চা করেছে, যেন এটিই স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু করুণা মানবিক নয়। মানবিক হচ্ছে সম্মান, বোঝাপড়া এবং সমর্থন। প্রতিবন্ধীরা আসলে খুব অল্প কিছু চায়—একটি আশ্বস্ত করা বাক্য, একটু বোঝাপড়া, এবং পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি। ঠিক এটুকু সমর্থন একজন মানুষের ভিতরকার শক্তিটিকে জাগিয়ে তোলে।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্টিফেন হকিং। যখন তিনি ALS রোগে আক্রান্ত হলেন, ডাক্তাররা বলেছিলেন, ‘তোমার হাতে আর দুই বছরের বেশি নেই।’ একজন ২১ বছর বয়সী ছেলের ওপর যে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, হকিংয়ের ওপর ঠিক সেটাই এসেছিল। কিন্তু তার পরিবার, স্ত্রী, শিক্ষক, সহকর্মীরা তাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। তারা বলেছিল, “তুমি বাঁচবে। তুমি কাজ করবে। তুমি পারবে।” হকিং তার শরীরের নয়, মন এবং প্রতিভার পরিচয় দিয়ে বাঁচতে পেরেছিলেন। তার ভালোবাসার মানুষ জেন হকিং, পাশে না থাকলে কি তিনি A Brief History of Time লিখতে পারতেন? কখনোই না।
আমাদের দেশে আক্কাস আলীদের কাছে কে দাঁড়ায়? প্রতিভা থাকলেও তারা কোথায় গিয়ে সেটার ব্যবহার করবে? চমস্কি বলেছেন, মানুষ জন্মগতভাবে সীমাবদ্ধ নয়; সীমাবদ্ধ হয় কাঠামোগত বাধার কারণে। এই কাঠামো—পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—যদি একজন প্রতিবন্ধীর দিকে সমর্থনশীল হাত বাড়ায়, তাহলে তার জীবন বদলে যায়। মুখ ফিরিয়ে নিলে পথ হয়ে যায় দীর্ঘ, কঠিন, অন্ধকার।

আইনস্টাইনের কথাও স্মরণযোগ্য। শৈশবে তাকে অনেকেই অমনোযোগী, ধীর, অক্ষম বলে ভাবত। তার শিক্ষকরা বলত, ‘একটি সমস্যাসংকুল শিশু।’ যদি পরিবার তাকে জোর করে ‘স্বাভাবিক’ বানাতে চাইত, তুচ্ছ করত, হয়তো পৃথিবী E=mc² পেত না। সব পরিবর্তনের শুরু হয় মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষমতার চোখে নয়, অক্ষমতার চোখেও নয়, সম্ভাবনার চোখে।
একজন প্রতিবন্ধীর জীবনকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে দেয় অবহেলা—রাষ্ট্রের হোক, সমাজের হোক, প্রিয়জনের হোক। একটি কঠোর বাক্য, একটি বিরক্তি, একটি ‘তোমার কারণে অসুবিধা হয়’—এগুলো একজন মানুষের ভেতরের আলো নিভিয়ে দিতে পারে। আক্কাস আলীর জীবনেও এমনটাই ঘটেছিল। সে করুণা পেয়েছে, ভালোবাসা খুব কম। পরামর্শ পেয়েছে, আশ্বাস খুব কম। মানুষ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেনি।
তার জীবনে যদি কেউ—একজন মানুষও—স্নিগ্ধভাবে হাত ধরে বলতো, ‘চল, আমরা এক সঙ্গে চেষ্টা করি,’ হয়তো আক্কাস আলী হারিয়ে যেত না। সমাজ যদি তার সক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিত, পরিবার যদি ভয় নয় বরং আস্থা দিত, রাষ্ট্র যদি ফাইলের স্তূপ নয় সহজ পথ দিত, তাহলে আরেকটি জীবনের গল্প হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো।

আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। অনেকে সহমর্মিতা জানাবে, বক্তৃতা দেবে। কিন্তু সত্য হলো, প্রতিবন্ধীদের সবচেয়ে বেশি দরকার সহমর্মিতা নয়—বরং ভালোবাসা, সমর্থন, আশ্বাস। একটি সমাজ যদি সত্যিই এগোতে চায়, তাকে শিখতে হবে কীভাবে একজন মানুষের সম্ভাবনাকে বড় করে দেখা যায়, কীভাবে তার পাশে দাঁড়ানো যায়, কীভাবে তাকে অংশীদার করা যায়।
প্রতিবন্ধী মানুষের অক্ষমতা নয়—তার চারপাশের মানুষের বোঝার অক্ষমতাই তার সবচেয়ে বড় বাধা। এই সত্যটা আমরা যদি একবার বুঝতে পারি, আর কোনো আক্কাস আলী নিঃশব্দে হারিয়ে যাবে না।
এনএম

