শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পুরুষ নিজের স্বপ্ন হারিয়ে সবার হাসি খুঁজে বেড়ায়

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:২৪ পিএম

শেয়ার করুন:

পুরুষ নিজের স্বপ্ন হারিয়ে সবার হাসি খুঁজে বেড়ায়

ছেলেবেলায় স্বপ্ন থাকে অনেক। কে যেন হবে একদিন সফল ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, কেউ সংগীতশিল্পী, কেউ আবার দিগন্ত ছোঁয়া ভ্রমণকারী। তখন স্বপ্ন ছিল হালকা, মুক্ত, নিঃশব্দ। কোনো দায় ছিল না, কোনো হিসাব ছিল না। কিন্তু সময় যখন গায়ে দায়িত্বের ভার চাপিয়ে দেয়, তখনই শুরু হয় বাস্তবতার হিসাব। মূলত একজন পুরুষ জীবনের পরতে পরতে নানা চ্যালেঞ্জ আর অনিশ্চয়তাকে মোকাবেলা করে কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেন। 
 
স্বপ্নই মানুষকে বাঁচায়, এগিয়ে নিয়ে যায়, জীবনকে অর্থ দেয়। কিন্তু বাস্তবতার এক পর্যায়ে এসে পুরুষের জীবনে সেই স্বপ্নের জায়গা দখল করে নেয় এক অদৃশ্য ভার- দায়িত্বের বোঝা। আমরা প্রায়ই দেখি, পুরুষ মানেই শক্ত, স্থির, নির্ভরযোগ্য- এমন সামাজিক ধারণা গভীরে গেঁথে আছে। কিন্তু সেই শক্ত মুখোশের আড়ালে থাকে অসংখ্য চাপ, দায়িত্ব, ত্যাগ এবং অস্বীকৃত পরিশ্রম।

ছেলেবেলায় পুরুষও স্বপ্ন দেখে বড় কিছু হওয়ার, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার, প্রিয় কাজ দিয়ে পৃথিবীকে ছুঁয়ে দেখার। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, পরিবার, এবং সম্পর্কের বাস্তব চাহিদা তাকে অন্য এক পথে নিয়ে যায়। সে বুঝতে শেখে, জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত থাকে অন্য কারও নিরাপত্তা, কারও সুখ, কারও ভবিষ্যৎ।


বিজ্ঞাপন


বাবার চিকিৎসা, মায়ের ওষুধ, স্ত্রীর নিরাপত্তা, সন্তানের ভবিষ্যৎ, এই প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি গুরু দায়িত্ব, যা পুরুষ চুপচাপ নিজের কাঁধে নেয়। স্বপ্নগুলো তখন আর বাতাসে ওড়ে না; তারা থমকে দাঁড়ায়। রাত জেগে অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা প্রেজেন্টেশন শেষ করা মানুষটা হয়তো একসময় গিটার বাজাত, এখন সেই গিটারে ধুলো জমে। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া ছেলেটি এখন ফোনেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সময় বের করতে পারছে না। যে ছেলেটি একদিন পৃথিবী ঘুরে দেখার শপথ নিয়েছিল, সে এখন ব্যাংক হিসাবের ঘর ঘুরে দেখছে, যেন মাসের শেষে বাচ্চার স্কুল ফি দিতে না হয় লজ্জা।

man-s-shadow-on-textured-asphalt-background-free-photo

তবুও পুরুষ কাঁদে না। সে হাসে, কথা কম বলে, কিন্তু চোখের নিচে ক্লান্তির দাগ তার নিঃশব্দ গল্প বলে দেয়। পুরুষের স্বপ্ন কখনো মরে না, সে শুধু নীরবে জায়গা ছাড়ে দায়িত্বকে। কারণ সে জানে, স্বপ্ন পূরণ না হলেও তার দায়িত্বের জয় মানেই পরিবারের শান্তি।

ছোটবেলায় আত্মকেন্দ্রিক ছেলেটিও একদিন দায়িত্বশীল পুরুষে পরিণত হয়। একসময় সে নিজের জন্য বাঁচতে চেয়েছিলেন, এখন বাঁচেন সবার জন্য। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্লান্ত শরীরে পরিশ্রম করেন, শুধু পরিবারকে নিরাপদ রাখতে। হয়তো কোথাও গভীরে তার নিজের কিছু না-পাওয়া আকাঙ্ক্ষা, অসমাপ্ত সুর, অপূর্ণ ভ্রমণ পড়ে থাকে; তবুও তিনি চুপচাপ দায়িত্ব পালন করে যান।


বিজ্ঞাপন


পুরুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য এখানেই- তিনি নিজের স্বপ্নকে ত্যাগ করেন, কিন্তু কাউকে দোষ দেন না। তিনি নিজেকে হারান, কিন্তু কাউকে জানান না। কারণ তিনি জানেন, দায়িত্বই তার স্বপ্নের নতুন রূপ। যেখানে নিজের অর্জন নয়, পরিবারের হাসিই সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

সমাজ প্রায়ই পুরুষের এই নীরব ত্যাগটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। কিন্তু সত্য হলো, প্রতিটি দায়িত্বশীল পুরুষের বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে এক অসমাপ্ত স্বপ্ন, যা সময় পেলে হয়তো আবার জেগে উঠবে। পুরুষের স্বপ্ন আর দায়িত্বের এই টানাপোড়েনই আসলে জীবনকে পূর্ণ করে তোলে। যেখানে ত্যাগের মধ্যেও থাকে ভালোবাসা, আর দায়িত্বের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে এক অনুচ্চারিত, অমলিন স্বপ্ন। সন্তানের স্বপ্ন। 

man5

পুরুষের জীবনে এক সময় আসে, যখন স্বপ্ন আর দায়িত্ব একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এক পাশে নিজের চাওয়া, অন্য পাশে পরিবারের প্রয়োজন। তখন সে বেছে নেয় দায়িত্বকে—কারণ সে জানে, দায়িত্বই তার ভালোবাসার অন্য নাম।

আবার নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা অনেকে ক্যারিয়ারে কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেননি। এমন ব্যক্তিটিও কি দায়িত্ব এড়াতে পারেন? সম্ভবত না। পরিবারের খরচ সামলানো, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা, মা-বাবার দায়িত্ব, বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। এসব চাপ একজন পুরুষকে প্রতিদিন এক অদৃশ্য দৌড়ে রাখে। সমাজ আবার দাবি করে- ‘পুরুষ মানেই রোজগারের মেশিন।’

ফলে আর্থিক অস্থিরতা বা পেশাগত ব্যর্থতা তাদের আত্মসম্মানেও আঘাত করে, যা মানসিকভাবে আরও ভেঙে দেয়। কিন্তু পরিবার বা সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই তার মানসিক হিসেব বুঝতে চান না। বুঝেন শুধু দায়িত্বের হিসেব। দায়িত্বে কাঠগাড়ায় দাড়িয়ে পুরুষ তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। 

পুরুষ একদিকে বাবা, অন্যদিকে স্বামী, আবার কখনো পরিবারের বড় ছেলে- একের পর এক ভূমিকায় তাকে মানিয়ে নিতে হয়। বাবা হিসেবে সন্তানের নিরাপত্তা, শিক্ষা ও ভবিষ্যতের চিন্তা, স্বামী হিসেবে পরিবার চালানো, সঙ্গীর মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ছেলে হিসেবে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন। 

man6

প্রতিটি ভূমিকায় পুরুষের অবদান বিশাল। কিন্তু অনেকেই স্বীকৃতি পান না, কারণ সমাজে প্রচলিত ধারণা- ‘এটাই তো পুরুষের কাজ।’ এই অবমূল্যায়ন তাদের মানসিক ভাঙনের অন্যতম কারণ।

ফলে মানসিক চাপ জমতে জমতে অনেক পুরুষ ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা নিঃসঙ্গতায় ভুগেন, কিন্তু তাও বলেন না। বাংলাদেশে পুরুষরা আত্মহত্যার হারেও শীর্ষে- এর বড় কারণ মানসিক চাপ ও আবেগ প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা। পরিবার কীভাবে পুরুষকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে পাওে এটি খুব জটিল নয়- শুধু একটু বোঝাপড়া, একটু মানবিকতা দরকার। তাই পুরুষের দায়িত্ব পালনে পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করা দরকার। 

পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যা করবেন-

১. তার কথাও শুনুন

পুরুষও কথা বলতে চায়, নিজের ভয়-দুশ্চিন্তা জানাতে চায়। শুনুন, বিচার নয়, বোঝার চেষ্টা করুন। তার সাহস বাড়িয়ে দিন। 

২. কঠোরতার মুখোশ ভেদ করে দেখুন

পুরুষ শক্ত মানুষ- এই ধারণা ভুল। তিনিও দুর্বল হতে পারেন। একটু পাশে দাঁড়ালেই বোঝা কমে। বাইরে কঠিন কিংবা ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ হলেও ভেতরে তিনি অনেক কোমল।  

man7

৩. দায়িত্ব ভাগ করুন

অর্থনৈতিক, পারিবারিক বা আবেগগত দায়িত্ব ভাগাভাগি করলে সম্পর্কও শক্ত হয়। দায়িত্ব হালকা হয়। কাজ করতে আনন্দ পান। 

৪. স্বীকৃতি দিন

পরিবারে কিংবা সমাজে পুরুষের যে অবদান থাকে তার স্বীকৃতি তাকে শক্তিশালী করে তোলে। আরও বেশি কাজে অনুপ্রাণিত হন। 

৫. আবেগ প্রকাশকে স্বাভাবিক করুন

পুরুষের কান্না, ভয়, ক্লান্তি- এসবও মানবিক। এসব গ্রহণ করলে পরিবার আরও সুস্থ ও নিরাপদ হয়।

পুরুষের হাসির আড়ালের সংগ্রামগুলো যদি আমরা দেখি, তাদের প্রতি একটু কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখাই তাহলেই পরিবার হবে আরও সুন্দর, সম্পর্ক হবে আরও মানবিক।

এমআর/এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর