সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক বিয়েকে কেন্দ্র করে ভাইরাল কনটেন্ট এখন ট্রেন্ড। দর্শক মজা পাচ্ছে, ক্রিয়েটর আয় করছে— কিন্তু সমাজ পাচ্ছে বিভ্রান্তি, পরিবার পাচ্ছে ভাঙন, আর তরুণ প্রজন্ম হারাচ্ছে মূল্যবোধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া পারিবারিক কলহ, একাধিক বিয়ে, কাপল ব্লগিং, সতীনের গল্প আমাদেরকে কি আসলেই ভালো কিছু শিক্ষা দিচ্ছে?
আমার এক স্কুলছাত্রীর মা কেঁদে বলেন, ‘আমার মেয়েটা ১৪ বছর বয়সী। ফেসবুকে একসাথে দুই স্ত্রী নিয়ে ব্লগ দেখে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে— ‘আমার স্বামীও কি একদিন এমন করবে?’ তখন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।’
বিজ্ঞাপন
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পড়ালেখা সংক্রান্ত কাজে মোবাইল ছেলে-মেয়েদের হাতে দিতেই হচ্ছে। আর পছন্দের তালিকায় না থাকলেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন এমন কিছু ভিডিও আমাদের সামনে চলে আসে যা আসলে রুচিহীন। যার ভাষা, চালচলন দেখে আসলেই পজিটিভভাবে শেখার কিছু নেই। যা কেবল অশালীন পোশাক, অপ্রীতিকর অঙ্গভঙ্গি, অকথ্য গালিগালাজের এক বিশাল সমারহ।

যদিও এটা নিছক একটি পরিবারের গল্প নয়। সামাজিক মাধ্যমে একাধিক বিয়ে নিয়ে ‘কনটেন্ট ক্রিয়েশন’-এর নামে যে ট্রেন্ড চলছে, তা এখন শত শত পরিবারে উদ্বেগ, বিভ্রান্তি ও ভাঙনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এরা আসলে কি করতে চায় এরা নিজেরাও জানে না। এবং এদের বেশিরভাগই বয়স ৩০ এর নিচে। এরা এই বয়সেই একাধিক বিয়ে করে স্বামী সন্তান বউ নিয়ে ফেসবুকে লাইভ করছে। ব্লগ বানাচ্ছে আবার ডিভোর্স দিচ্ছে। লাইভে এসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। একে অপরকে শুধু নয় ওদের পরিবারকে প্রতিটি সদস্যদের নিয়েও নোংরামি ছড়াচ্ছে, সেখানে মা বাবা ভাই বোন সবাই জড়িয়ে যাচ্ছে।
আর সেই সাথে আমাদের সমাজ নষ্টের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। সব থেকে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এদের সন্তানরা আসলে কি দেখে বড় হচ্ছে, ডিভোর্সের কারণে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরকে জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। আশেপাশের সামাজিকতা বাদই দিলাম, এদের সন্তানরা এগুলো দেখবে, দেখছে- এরা কী শিখছে।
বিজ্ঞাপন
ভাইরাল কনটেন্টের দুনিয়া:
‘স্ত্রী-স্ত্রীর ঝগড়া’, ‘দ্বিতীয় বিয়ের লাইভ’, কিংবা ‘দুই স্ত্রী নিয়ে সুখী জীবন’—এমন ভিডিও বা ব্লগ ফেসবুকে সহজেই লাখো ভিউ পাচ্ছে। কৌতূহলী দর্শক ভিড় জমাচ্ছে, আর ক্রিয়েটররা পাচ্ছে টাকা। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই হাসি-তামাশার আড়ালে তৈরি হচ্ছে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বীজ।

বাস্তব প্রভাব:
বিয়ের কিছুদিন পরেই ভাঙছে সম্পর্ক, বাড়ছে অনিশ্চয়তা। কিন্তু ডিভোর্স নিয়েও চলে ভিউ বাণিজ্য। এরপরে যদি থাকে সন্তান তাহলে তো কথাই নেই। একবারও ভেবে দেখে না সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, এই সন্তানটা কেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে, তার মানসিক অবস্থা কেমন হবে?
এসব দেখে অনেক নারীরা নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কিশোর-কিশোরীরা মনে করছে একাধিক বিয়ে করা স্বাভাবিক, এমনকি ট্রেন্ডি। পরিবারে বাড়ছে সন্দেহ, ঝগড়া এবং সন্তানদের মানসিক অস্থিরতা।
সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবকে হালকাভাবে দেখলে চলবে না। ছোট বয়সে যে ধারণা মনে জন্ম হয়, তা সারা জীবনের চিন্তায় প্রভাব ফেলে। একাধিক বিয়ের মতো বিষয়কে বিনোদন হিসেবে প্রচার করা তরুণদের মনে পারিবারিক সম্পর্কের প্রতি অনাস্থা তৈরি করছে।
এখানে ধর্ম ও সংস্কৃতির অপব্যবহার যথেষ্ট। যদিও অনেকেই ধর্মীয় বৈধতার কথা বলে এই ট্রেন্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা বলছে, এর মূল উদ্দেশ্য ধর্ম নয়—বরং দর্শক টেনে আনা এবং মনিটাইজেশন। এতে আসলে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা আড়ালে পড়ে যাচ্ছে।
পরিত্রাণের উপায় কী?
অভিভাবকের ভূমিকা: সন্তান কী দেখছে, কত সময় ব্যয় করছে—এতে নজরদারি জরুরি। সন্তানের স্ক্রিন টাইম লিমিটেড করা সহ সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারের যথেষ্ট সতর্কতা জরুরী।
স্কুল পর্যায়ে শিক্ষা: মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের কনটেন্ট বাছাইয়ের ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সরকারি উদ্যোগ: ফেসবুক ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে একাধিক বিয়ে প্রমোটিং কনটেন্টসহ যে কনটেন্ট গুলো সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলে তা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ করতে হবে।
বিকল্প কনটেন্ট: ইতিবাচক, সংস্কৃতিমূলক ও শিক্ষামূলক কনটেন্ট নির্মাণকে উৎসাহিত করতে হবে।
ফেসবুকে একাধিক বিয়ে প্রমোশনকে অনেকেই মজা বা এন্টারটেইনমেন্ট ভেবে নিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব ভয়াবহ—ভাঙছে সংসার, বিভ্রান্ত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, আর ধ্বংস হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ আরও বড় সংকটে পড়বে।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শিল্পপুরাণ
এনএম


