ঢাকার ব্যস্ত নগরজীবনে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে চলে কাজের উদ্দেশে। ভিড়ভাট্টার মধ্যে চোখে পড়ে নানা রঙের কোলাহল। ফুটপাথে এক পাশে সাজানো থাকে প্লাস্টিকের খেলনা, অন্য পাশে কসমেটিকস, আবার কোথাও মোবাইলের এক্সেসরিজ।
তবে এসব আধুনিক পণ্যের ভিড়েও চোখ আটকে যায় অন্য এক মাটির জগতে। সারি সারি কলস, হাঁড়ি-পাতিল, ব্যাংক, রঙিন টেপা পুতুল আর ফুলদানি যেন মনে করিয়ে দেয়, আমরা একসময় কতটা মাটির সঙ্গে মিশে বেঁচে ছিলাম।
বিজ্ঞাপন

ঐতিহ্যের শেকড়
মাটির শিল্পের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। বাংলার কুমোর সম্প্রদায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রাচীন গ্রামীণ জীবনে মাটির হাঁড়ি-পাতিল ছাড়া রান্না কল্পনাই করা যেত না। ভাত রান্না হতো মাটির হাঁড়িতে, পানি রাখা হতো কলসে, অতিথিকে খাওয়ানো হতো মাটির থালায়। ছোটদের খেলার জন্য তৈরি হতো মাটির পুতুল, যা তাদের আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি সৃজনশীলতাও বাড়াতো।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টেইনলেস স্টিল আর চাইনিজ সামগ্রী বাজার দখল করে নেয়। তবুও ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে মাটির জিনিস এখনো টিকে আছে। ঢাকা শহরের নিউমার্কেট, শাহবাগ, বায়তুল মোকাররম মসজিদ সংলগ্ন এলাকা, সদরঘাট, পুরান ঢাকা, গাবতলী ও বিভিন্ন হাটে এখনো মাটির জিনিসপত্র পাওয়া যায়।
বিজ্ঞাপন

কী কী পাওয়া যায়?
ঢাকার ফুটপাথে সাজানো মাটির দোকানগুলোতে চোখ মেললেই দেখা যায় এক রঙিন জগৎ। এখানে পাওয়া যায় রান্নার হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে শখের শো-পিসসহ নানা রকম সামগ্রী। কেউ এখনো ভাত, ডাল বা তরকারি রান্না করেন মাটির হাঁড়িতে, যা খাবারে আলাদা স্বাদ আনে। গরমের দিনে মাটির কলসে রাখা পানি ঠান্ডা ও স্বাদে অনন্য। তাই এখনো অনেক পরিবার কলস ব্যবহার করে।
অতিথি আপ্যায়ন বা গ্রামীণ উৎসবে ব্যবহৃত প্লেট, থালা-বাটি মাটির জিনিসের মধ্যে আলাদা আবেদন রাখে। শিশুদের জন্য আছে মাটির ব্যাংক, যেখানে প্রথম সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে ওঠে। টেপা পুতুল শুধু খেলার সামগ্রী নয়, গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবেও জনপ্রিয়।
আধুনিক ফ্ল্যাট কিংবা অফিস সাজাতেও মাটির ফুলদানি ও শো-পিস ব্যবহার করা হয়। পূজা বা বিশেষ উৎসবে প্রদীপ জ্বালানো হয় মাটির প্রদীপে। পাশাপাশি ঘর সাজানোর জন্য পাওয়া যায় নানা ধরনের মূর্তি প্রাণীর অবয়ব, গ্রামীণ দৃশ্য কিংবা আলপনার নকশা। সব মিলিয়ে এই দোকানগুলো শুধু পণ্য বিক্রির জায়গা নয়, বরং আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রদর্শনী।

শাহবাগ ফুটপাথে বসে থাকা বিক্রেতা মো. আলম বলেন, ‘মানুষ এখন মাটির হাঁড়ি-পাতিল খুব একটা কেনে না। আগে গ্রামে মাটির হাঁড়িতে রান্না না হলে খাবারের স্বাদই হতো না। এখন স্টিল আর প্লাস্টিক দখল করে নিয়েছে বাজার। তবুও কিছু মানুষ এখনো শখ করে মাটির পুতুল, ব্যাংক কিংবা ফুলদানি নেয়। বৈশাখের সময় আমাদের ব্যবসা কিছুটা জমে ওঠে।’
তারপরও সারা বছর সংসার চালানো খুব কঠিন হয় জানিয়ে এই বিক্রেতা বলেন, ‘পাইকারি দামে কুমোরদের কাছ থেকে কিনে আনতে হয়, পরিবহন খরচ আলাদা। ফুটপাথে বসতে গেলেই পুলিশকে টাকা দিতে হয়। সব হিসাব কষে দিনে যা হাতে থাকে, তা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চলে। কখনো মনে হয় এই পেশা ছেড়ে দেব। কিন্তু আবার চিন্তা করি, এটাই তো আমাদের পৈতৃক ঐতিহ্য।’
শাহবাগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী লাবণ্য দাস মাটির হাড়ি হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি লোকশিল্প খুব ভালোবাসি। ঘর সাজানোর জন্য প্রতি বছর কিছু না কিছু মাটির জিনিস কিনি। ভাত রান্নার ক্ষেত্রে আমি মাটির হাড়ি ব্যবহার করি। দামও খুব বেশি না। তবে দুঃখের বিষয় হলো, শহরে এখন খুব কম জায়গায় এসব পাওয়া যায়। যদি আমরা, নতুন প্রজন্ম, এগুলো না কিনি, তাহলে একসময় হয়তো একেবারেই হারিয়ে যাবে। তাই শখের জন্য হলেও আমি বৈশাখে মাটির জিনিস কিনে থাকি।’

পুরান ঢাকার চকবাজারে মাটির কলস কিনছিলেন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মাটির কলসের পানি খেতে দারুণ লাগে, ঠান্ডা আর স্বাস্থ্যকর। আমাদের বাসায় এখনো আমি পানি রাখি কলসে। সত্যি বলতে গেলে, বাজারে যদি এখনো এসব টিকে থাকে, সেটা শুধু ঐতিহ্য আর প্রয়োজনের জন্য। তবে মান সব জায়গায় একরকম পাওয়া যায় না, অনেক সময় ভঙ্গুর হয়ে যায়। তারপরও আমি চাই এই শিল্প টিকে থাকুক। কারণ এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক, আমাদের দাদা-নানারা এগুলো ব্যবহার করতেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরামিক বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার শিকদার বলেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মাটির শিল্পের ব্যবহারিক গুরুত্ব অনেক। মাঝখানে কিছুটা কমে গেলেও এখন আবার মানুষ এগুলোকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। দেশীয় পণ্য হিসেবে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ছে, দোকানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জনপ্রিয়তাও ধীরে ধীরে বাড়ছে, যদিও সব অঞ্চলে বিক্রি সমান নয়।’
তিনি জানান, বরিশাল, বাউফল, কনকদিয়া ও বগা অঞ্চলের কুমোরদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো হলেও অন্যান্য এলাকায় তাদের অবস্থান ততটা শক্ত নয়। সরকারি উদ্যোগে কিছু ট্রেনিং দেওয়া হয়, তবে কারিগররা মূলত উৎপাদনেই জোর দেন, ডিজাইনের দিকে তেমন মনযোগী নন।

অধ্যাপক শিকদারের মতে, ‘মানুষের রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে এবং কোয়ালিটি বজায় না রাখলে এই শিল্প টিকবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাউফলে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার কারিগর কাজ করছেন এবং দিন দিন তাদের পণ্যের ব্যবহারিক গুরুত্ব বাড়ছে।
শিকদার মনে করেন, শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, বরং মান বজায় রেখে কাজ করলেই এই শিল্প এগিয়ে যাবে। তবে তিনি সতর্ক করেন, কিছু কারিগর ভারত থেকে ডাইস এনে নকল প্রোডাকশন করছেন, যা প্রথমে বিক্রি হলেও টেকসই নয়। তবু সার্বিকভাবে বাউফল এখন মাটির শিল্প উৎপাদন ও বিক্রিতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং জনি আর্ট অ্যান্ড সিরামিকের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন জনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে মাটির শিল্প গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। একসময় গ্রামীণ জীবনে হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল বা ব্যাংক ছিল ব্যবহারিক ও আবেগের অংশ। এখন শহরে, বিশেষ করে ঢাকার ফুটপাথে এগুলো ব্যবহারিকের চেয়ে সাজসজ্জা বা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে।’
তিনি জানান, ‘কুমোর সম্প্রদায় আজ বড় সংকটে। চাহিদা কমেছে, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন বাড়ছে, আর তরুণ প্রজন্ম এ পেশায় আসতে চাইছে না। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দরকার আধুনিক ডিজাইন ও সৃজনশীল ব্যবহার, সরকারি সহায়তা, স্কুল-কলেজে পরিচিতি, অনলাইনে বাজার সম্প্রসারণ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে একে পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিক বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা।’

ঢাকার ফুটপাথে মাটির দোকানগুলো শুধু ব্যবসার কেন্দ্র নয়, এগুলো আসলে একেকটি জীবন্ত জাদুঘর। বিক্রেতাদের আক্ষেপ, আয়ের অভাব, সরকারি সহযোগিতা নেই, বাজার ছোট হয়ে আসছে। ক্রেতারা বলেন, স্মৃতি, ঐতিহ্য আর শখের কারণে তারা কিনে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এখনই উদ্যোগ না নিলে কয়েক দশকের মধ্যে এই শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
একসময় এই মাটির জিনিস ছাড়া মানুষের জীবন কল্পনাই করা যেত না। আজ তা টিকে আছে কেবল শখ আর ঐতিহ্যের টানে।
ঢাকার ফুটপাথে সাজানো মাটির হাড়ি-পাতিল, কলস, ব্যাংক আর টেপা পুতুল কেবল জিনিস নয় এগুলো ইতিহাসের সাক্ষী, লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক। এগুলো হারিয়ে গেলে শুধু শিল্প হারাবে না, হারাবে আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ও। প্রশ্ন হলো, আমরা আসলেই কতটা আগ্রহী আমাদের শেকড় বাঁচিয়ে রাখতে?
যদি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মাটির শিল্পকে জায়গা দেওয়া যায়, তবে হয়তো ব্যস্ত ঢাকা শহরের ফুটপাথেও রঙিন মাটির পুতুল, হাড়ি-পাতিল আর ব্যাংক সাজানো থাকবে আরও অনেক বছর।
এম/এএইচ

