২০২০ সালেরমার্চের মাঝামাঝি সময়। দেশে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে করোনাভাইরাস। এমন অবস্থার মধ্যে ভয়ে ভয়ে যাওয়া হলো মেডিকেলে। টেস্টের পরদিন ডাক্তার জানালেন এখনো খুশির খবর দেওয়ার সময় আসেনি। চান্স ফিফটি-ফিফটি। আরও দুই তিন সপ্তাহ পর আবার আসতে হবে। এর মধ্যে স্ত্রী তার ডাক্তার বান্ধবীকে সব রিপোর্ট পাঠাল। তিনি রাতেই ফোন দিয়ে বললেন এটা প্রেগনেন্সি না, টিউমার!
প্রায় মধ্যরাতে দুইজনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। অথচ মেডিকেলের ডাক্তার খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বউ তো কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমি কী করবো বুঝে উঠতে না পেরে মধ্যরাতেই ডাক্তারকে ফোন দিলাম। তাকে সব বললাম যে এক বান্ধবী এমনটি বলেছেন। তখন ডাক্তার বুঝিয়ে বললেন যে আপনাদের ওই বান্ধবীর ভুল হয়েছে। আর চিন্তার কোনো কারণ নেই।
বিজ্ঞাপন
এরই মাঝে দেশজুড়ে শুরু হলো কঠোর লকডাউন। আমরা অপেক্ষা করি এক একটি দিন। তিন সপ্তাহ পর পুনরায় টেস্ট করা হলো। কিন্তু ডাক্তার লকডাউনের কারণে পরের সপ্তাহে এপোয়েন্টমেন্ট দিলেন। দিন যেন শেষ হয় না। অতঃপর নির্দিষ্ট দিনে ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন এখনই আবার টেস্ট করুন। এখানে এতদিনে হার্টবিট চলে আসার কথা কিন্তু রিপোর্টে আসেনি। দুই জনের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেলো।
ডাক্তার কাগজে ইমার্জেন্সি লিখে দিলেন। যাওয়ার সাথে সাথে নতুন করে আল্ট্রাসোনোগ্রাম করে দিলো। ডাক্তার বসেন চতুর্থ তলায়। আর পরীক্ষা করাতে হয়েছে ষষ্ঠ তলায়। এই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার আধা ঘণ্টা এবং ছয় তলা থেকে লিফটে চতুর্থ তলায় আসার সেই সময়টা কখনো ভুলব না। ডাক্তার রিপোর্ট দেখেই বললেন সুখবর। আপনারা মা-বাবা হতে যাচ্ছেন। সেই সময় দুজনেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
করোনায় সবাই ঘরে বন্দি। বাসায় আমরা শুধু দুজন। হোম অফিস আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল। ঘরের আর অফিসের বেশিরভাগ কাজ আনন্দের সঙ্গে করতে শুরু করলাম। এর পাশাপাশি বাচ্চার হবু মায়েরও যত্ন যতটুকু গুগল ঘেঁটে আর আম্মুর পরামর্শে যতটুকু করা যায় করতে থাকলাম। তারপর নিয়মিত ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে আলহামদুলিল্লাহ দিন কেটে যেতে লাগল। শেষের দিকে শ্বশুর বাড়িতে শিফট হয়ে গেলাম। কারণ হোম অফিস শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সহকর্মী আশিক ভাই ও ঢাকা মেডিকেলের কয়েকজনের আশ্বাসে সিদ্ধান্ত নিলাম সেখানেই জন্ম নেবে আমার সন্তান। এরপর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ (বুধবার) আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তাদের কথা মতো দুই ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করে রাখা হলো। ছোট ভাই মোফাস্সির নিজ উদ্যোগে রক্তের গ্রুপ কনফার্ম করে হাজির হলেন। এছাড়া এক ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড রক্ত দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন।
বিজ্ঞাপন
রাত এগারোটার দিকে আমার স্ত্রীকে ওটিতে ঢোকানো হলো। ওটিতে ঢোকানোর আগে ডাক্তার বললেন দুই ব্যাগ রক্তই রেডি রাখতে হবে। আমরা এক ব্যাগ রেডি রেখেছিলাম। এবার সেই বন্ধুর বন্ধুকে কল দিলে জানান যে এত রাতে খুব মুশকিল হবে যাওয়া। অগত্যা আরও কয়েকজন বন্ধুকে ফোন দিয়ে উপায় না হওয়ায় তাকেই আবার অনুরোধ করলাম। তিনি একজনকে সাথে করে এসে রক্ত দিয়ে গেলেন।
একদিকে স্ত্রী ওটিতে। অন্যদিকে আমি দ্বিতীয় ব্যাগ রক্তের পেছনে ছুটছি। এরই মধ্যে কাছে পুরুষ কেউ না থাকায় বন্ধু সাখাওয়াতকে মেস থেকে ডেকে নিলাম। ওকে খবর জানার জন্য ফোন দিলে প্রথম কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। আমার সন্তানের কান্না!
সকালে বাসা থেকে মেডিকেলে যাওয়া, রাত ১১:১৬ মিনিটের দিকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা পর্যন্ত বহু কিছুই হয়েছে কিন্তু কোনো বোধই যেন কাজ করেনি। শুধু করতে হবে এটাই মাথাই ছিল। খাওয়া-দাওয়ার কথা মনেও নেই। রাতে মেডিকেলের পোস্ট অপারেটিভ রুমের বারান্দায় তোয়ালে দিয়ে মোড়া বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শেষ রাত পর্যন্ত বসে থাকার স্মৃতি মুছে যাওয়ার নয়। শেষ রাতে বাচ্চা ও তার মাকে বেডে দেওয়া হলো। এরপর কোথায় কী লাগবে সবই করলাম একাই।
একটু পরপর ওষুধ, এটা ওটা আনতে ছুটতে হচ্ছে বাইরে। পরদিন সকাল দশটা এগারোটার দিকে মোটামুটি সবই একটা স্টেবল পর্যায়ে আসার পর মনে হলো আমি খিদেতে সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছি, না ঘুমানোয় শরীর আর চলছে না। একটা হোটেলে গিয়ে মন ও পেট ভরে খেলাম।
দুই দিনের দৌড়াদৌড়ির মধ্যে একটা ঘটনা যেটা না বললেই নয়। এক মহিলা ও এক মধ্য বয়স্ক পুরুষ দেখি হন্যে হয়ে রক্ত খুঁজছেন। তাদের একমাত্র সন্তান এক্সিডেন্ট করেছে। জিজ্ঞাসা করতেই জানাল এ+ রক্ত লাগবে। আমারও একই গ্রুপ। রক্ত দেয়ারও সময় হয়েছে। কিন্তু পরিশ্রম, খাবারহীন ও ঘুমহীন শরীরের এমন অবস্থা যে রক্ত দিলে নিজের কাজ করতে পারবো কি না নিশ্চিত না। তারপরও তাদের দেখে সেখান থেকে ফিরে আসতে মন সায় দিলো না। তাদেরকে বললাম চলেন আমি রক্ত দিব। আমিই সব রিসিট নিয়ে সবকিছু রেডি করে তাদের রক্ত দিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ খারাপ লাগলেও পরে এটা ওটা করতে গিয়ে রক্ত দেয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
সেদিন থেকে আমার বাবা হওয়ার প্রশিক্ষণ চলছে। ছোট্ট সেই ছানাটা এখন দৌড়াতে শিখেছে। কথাও অনুকরণ করা শিখেছে। আমার বাবা হওয়ার প্রশিক্ষণের দেড় বছরের একটু বেশি সময় হয়েছে। এখনো বাবা হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করছি নিয়মিত।
সন্তানের প্রথম স্পর্শ থেকে শুরু করে হাত দিয়ে ছোঁয়া, প্রথম নিজে নিজে উল্টাতে পারা, হামাগুড়ি, বসতে শেখা, এরপর দাঁড়ানো, এক পা দুই পা করে চলতে শেখার প্রতিটি ধাপ জীবনের মধুরতম স্মৃতি।
বাবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের বাবাকেও প্রতিক্ষণে মনে পড়ে। কখনো বিলাসী জীবন না কাটালেও কোনো কিছুর কমতি হতে দেননি আব্বু। শিক্ষা দিয়েছেন সততার, দায়িত্বশীলতার, মানুষ হওয়ার। আব্বুর থেকে পাওয়া শিক্ষা বাবা হিসেবে কাজে লাগাতে চাই। সন্তান মানুষ হোক, সৎ থাকুক এই শিক্ষা যথাসম্ভব দিতে চাই। নিশ্চয় আল্লাহ আমার সহায় হবেন।
একে/এনএম

