সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বাবাকে ঘিরে যত অনুভূতি 

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২২, ১১:৩০ এএম

শেয়ার করুন:

বাবাকে ঘিরে যত অনুভূতি 

জীবনের প্রথম পর্যায় থেকে প্রতিটি কাজে সন্তানকে বাহবা দিয়ে আসেন যে মানুষটি তিনি হলেন বাবা। নিজের সুখ বা প্রয়োজন বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জন্য খেটে যান তিনি। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বিশ্ব বাবা দিবস। বিশেষ এই দিবসটি উপলক্ষে অনেকে জানিয়েছেন বাবাকে নিয়ে তাদের অনুভূতি। কেউবা জানিয়েছেন নিজেদের বাবা হওয়ার অনুভূতি। 

শরিফুল ইসলামের মতে, বাবা মানে আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা। নিজের বাবা তার কাছে সেরা। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বাবাকে প্রচুর ভয় পেতাম। এখনও অনেক ভয় পাই। তবুও অনেক ভালোবাসি বাবাকে।’


বিজ্ঞাপন


বাবাকে আদর্শ মনে করেন সুরাইয়া ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা কেয়ারিং, ধৈর্যশীল আর পরিশ্রমী মানুষ। আমিও তার মতো হতে চাই। আল্লাহ তাকে আরও দীর্ঘজীবী করুক।’

father

রাতুল খন্দকারের কাছে বাবা হলেন বন্ধুর মতো। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বাবা মানেই বটবৃক্ষ মাথার ওপর বিশাল ছায়ার মতো, সবচেয়ে বড় সাপোর্ট। যত বিপদই আসুক না কেন বাবা থাকলে মানসিক শক্তিটা আপনাআপনি চলে আসে। আমাদের মা নেই বারো বছর, তারপর বাবাই আমাদের আগলে রেখেছেন, কখনো বুঝতে দেননি মা থাকলে বাবা আরও বেশি কিছু করতো এইরকম অনুভূতি। বরং আরও বেশি করে সব দিয়ে আমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন সবসময় বাবা।’

‘আমাদের বাবা খুব সহজ ভালো মানুষ, জীবনে কখনো দেখিনি বাবার কারো সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, বাবা হাসি মুখে সব শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলেন সবসময়। যার মুখে হাসি ছাড়া কেউ কখনও দেখেনি কিছু। এই ভালো মানুষটা আরও বহুকাল হেসে মুক্তো ঝরাক। বাবা সবসময় বলতেন-"তুমি যদি ভালো হও তবে জগত ভালো, তুমি যদি জীবন সহজভাবে নাও তবে জীবন সহজ, কঠিনভাবে নাও তবে জীবন কঠিন।"’- যোগ করেন রাতুল। 


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও বলেন, ‘মাঝেমাঝে বাবাকে ম্যাজিশিয়ানও মনে হতো যিনি হাসি মুখে সব চাওয়া, পাওয়ায় পরিণত করতে পারেন। চারপাশে দেখে এসেছি, শুনে এসেছি বাবারা একটু গম্ভীর হয়, রাশভারী হয় কিন্তু আমার বাবা শুধু বন্ধুই আমার। প্রিয় বন্ধুকে যা বলতে পারিনা বাবার সাথে তাও শেয়ার করতে পারি। বাবা জোরে আমার সাথে কথা বলেছেন এমন কোন স্মৃতি নেই আমার। তিনি শুধু ভালোবাসতে জানেন।’

fatherযারা বাবা হয়েছেন তারাও পিতৃত্বের স্বাদ পেয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন নতুন করে। কন্যা স্বরিৎ ঋতি ভোরকে নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ওয়াসেক বিল্লাহ আল-ফারুক বলেন, ‘মেয়ে হওয়ার পর থেকে অনেক ধৈর্যশীল হয়েছি, হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা নেই। দায়িত্ববোধ বেড়েছে। আমার বাবা মায়ের কষ্টটাও এখন উপলব্ধি করতে পারি আরও বেশি।’

বাবাদের অসুস্থতা ছুঁয়ে যায় সন্তানদের। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে লামিয়া আলভির কামনা, আরও কয়েকটা বছর যেন বাবার ছায়া মাথার ওপর থাকে। তিনি বলেন, ‘বাবা একটা বড় অসুখের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। তবুও চাই আর কয়েকটা বছর অন্তত আমার মেয়েটা নানা ডাকুক। আর কয়েকটা বছর আমার ফোনে আব্বুর নাম্বার থেকে ফোন আসুক। সেটা ঠিক আর কতদিন জানি না। আশায় বুক বাঁধতে ক্ষতি কী!’

একই রকম অনুভূতি তানিয়া তন্বীর। তিনি বলেন, ‘আব্বা যখন মাইনর স্ট্রোক করলেন প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা কেউ ধরতেই পারলাম না যখন ডিমেনশিয়াতে ভুগতে লাগলেন টের পেলাম আব্বা আস্তে আস্তে আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন। আব্বা এখন কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। চুপচাপ বসে থাকেন সারাদিন। মাছ খেতে পছন্দ করলেও এখন প্রায়ই কী মাছ দিয়ে খাচ্ছেন তা আর খেয়াল করতে পারেন না তিনি।’

father ‘এখন হুট করে দেখলে বাবা তাকিয়ে থাকেন। হয়তো মনে করার চেষ্টা করেন কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু দিন তো চলে যাচ্ছে, সময় বাড়ছে। মানুষটার ভাবনার গন্ডিতে সময় আটকে যাচ্ছে।’- যোগ করেন তন্বী। 

প্রিয় মানুষটি পাশে থাকুক কে না চায়। তবু প্রকৃতির নিয়মে বিদায় নিতেই হয়। সন্তানকে হতে হয় পিতৃহারা। সাফিনাজ মোস্তফা বাবাকে নিয়ে শেষ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সবসময় ভাবতাম বাবাকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারবো না। সেই আমি যেদিন শুনলাম আমার বাবা আর নেই সেদিন আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমার চোখ দিয়ে পানিও আসলো না। কেমন জানি হয়ে গেলাম। আমি ঢাকা থেকে ভোলায় গেলাম বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। তখনও আমি স্বাভাবিক।’

‘যখন যেয়ে দেখলাম বাবাকে সাদা কাপড়ে শুইয়ে রেখেছে তখন আমি বাবার পা দুটো ধরলাম। তখন আমার মনে হয়েছে আমার বাবা তো নেই। আমি শুধু বলছিলাম বাবা তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। আল্লাহ কেনো তুমি আমার বাবাকে নিয়ে গেলে আমাকে এতিম করলে?’- যোগ করেন সাফিনাজ। 

fatherগোবিন্দ দেব আর্য বলেন, ‘বাবার প্রতি ভালোবাসাটা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারিনি কোনদিনই, তবে কমতি ছিল না বিন্দুমাত্র। ঘটা করে শ্রদ্ধাভরে ভক্তি প্রকাশ করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু অপ্রকাশিতভাবে ভক্তি ও শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না কোনদিনই। হয়তো বাবাদের প্রতি বেশিরভাগ সন্তানের ভালোবাসা এরকমই অপ্রকাশিত থাকে! তাইতো, বাবার সাথে ভালো কোনো ছবিও নেই আমার। এইতো সামনে জুন এর ২৪ তারিখ বাবার ২য় মৃত্যু বার্ষিকী। অনেক অসমাপ্ত কথা বলার ছিল বাবার কাছে, জানার ছিল অনেক কিছু, তা আর হলো না! আমার বাবা নীতি-নৈতিকতায়, সততায়, কর্মে এবং বিশ্বাসে একজন অটল মানুষ ছিলেন। তার আদর্শেই আজও আমরা পরিবারের সবাই উজ্জীবিত।’

এখনও বাবাকে মনে পড়ে সুমাইয়া ইসলাম সিনথীয়ার। বাবার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ঠিক ৮৮৬ দিন আগে হারিয়েছিলাম তোমায়। সকালটা শুরু হতো তোমার ডাকে। তুমি যেদিন ওমরাহ হজ্বের জন্য ইহরামের সাদা ধবধবে কাপড়টা এনেছিলে সেদিন না আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই কাপড় এখানে কেনো? এটা তো কাফনের কাপড়। আম্মু উত্তরে বলেছিলেন, এটা পরে হজ্ব করতে হয় তারপর তোর আব্বু মারা গেলে এই কাপড় দিয়েই কাফন করা হবে। আমি এই কথা শুনে ওই কাপড় জড়িয়ে অনেক কেঁদেছিলাম।’

father

‘যে ভোররাতে তুমি চলে যাবে তার আগে একসাথে খাওয়ার সময় তোমাকে গর্ব করে বলেছিলাম হজ্ব করতে নিয়ে যাব একদিন তোমাদেরকে। কিন্ত আর হলো কই? যখন তুমি অসুস্থ অনুভব করছিলে তখন যদি তুমি কুটুসকে ফোন করতে দিতে তাহলে হয়তো তোমাকে ফেরত পেতাম। জানো আব্বু, এখনো মনে হয় তুমি আছো আশে পাশে। যখন কলেজে যাই মনে হয় আর পথ না এগিয়ে গোরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখি। মাঝে মাঝে মনের ভুলে কোচিং শেষ করে দাঁড়িয়ে থাকি তোমার অপেক্ষায়! আব্বুজ্বি তুমি কি ওই তারাদের দেশ থেকে দেখো আমাদের? আবার কবে দেখা হবে তোমার সাথে?’

বাবাকে নিয়ে সন্তানদের গর্বও হয়। ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘কোথাও একটা পড়েছিলাম, প্রতিটা সার্থক/ স্বাবলম্বী মেয়ের একজন বাবা আছে যে তার মেয়েকে বিশ্বাস করেছিলো, সমাজকে নয়। কথাটা আমার জন্য পুরোপুরি সত্য। খাতা-কলমে আমার আব্বু স্বাক্ষর জ্ঞানহীন। কিন্তু এই জীবনে তাকে অশিক্ষিত মানুষের মতো কোনো কাজ করতে বা কিছু বলতে আমি দেখিনি। আমার জীবনে একমাত্র ব্যক্তি যে কখনো কোনোভাবে আমাকে আঘাত করেননি। আমার চোখে আমার আব্বু সেরা জ্ঞানী মানুষ। আজ আমার নতুন জবে জয়েনিং। পুরো জীবনে যা যা অর্জন করবো তার পুরোটাই আব্বুর কৃতিত্ব। আমার জীবনের আদর্শ আমার আব্বু।’

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর