আমাদের জীবনে কিছু সম্পর্ক এমন থাকে, যেগুলো কেবল অনুভব করার জন্য—বোঝার জন্য। প্রকাশ করার নয়। ‘বাবা’—এই শব্দটি নিঃশব্দ অথচ পাহাড়সম ভালোবাসার নাম।
আমরা ‘মা’ বলেই কাঁদি, মাকে জড়িয়ে ধরি, তার কাছে যত আবদার। অথচ বাবার সামনে দাঁড়ালে বুকের ভেতরটা কেমন টনটন করে ওঠে। হয়তো সেটা ভয় নয়, সম্মান। নয়তো এমন এক ভালোবাসা—যার ভাষা আমরা কোনোদিন শিখিনি।
বিজ্ঞাপন
মা তার ভালোবাসা নিয়ে যতটা প্রকাশ্য, বাবা ততটাই গোপন ভালোবাসার নাম। তিনি না বলেই বলে দেন হাজারটা কথা—চাহনিতে, স্পর্শে, নির্ভরতায়। দূরে থেকেও তিনি কেমন করে যেন আমাদের ছায়া হয়ে পাশে থাকেন, প্রতিনিয়ত।

বাবা সেই মানুষ, যিনি নিজের সব চাওয়া–পাওয়া, স্বপ্নগুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে আমাদের জন্য ভবিষ্যতের ভিত গড়ে তোলেন। যিনি দিনের পর দিন পুরনো জামা পরে থাকেন, যাতে সন্তানের স্কুলে নতুন পোশাক হয়। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত মুখেও আমাদের এক চিলতে হাসির জন্য অপেক্ষায় থাকেন।
শৈশবের স্মৃতিগুলোতে বাবার উপস্থিতি যেন এক নিঃশব্দ ছায়া। সময়ের সাথে সেই সম্পর্কটাও বদলে গেছে—ব্যস্ততা এসে আমাদের আবদ্ধ করেছে। তবু বাবার ভালোবাসা ঠিক আগের মতোই আছে—নিরব, নিঃস্বার্থ, বিশাল।
বিজ্ঞাপন
হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে তিনি কোনো আদুরে ভাষা ব্যবহার করেন না। শুধু বলেন, “চল, আবার উঠে দাঁড়া।” এই একটি বাক্যেই যেন সমস্ত সাহস ঢুকে যায় শরীরজুড়ে।

ছোটবেলায় বাবার কাঁধে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, হয়তো ওটাই আমার গন্তব্য। আজ বুঝি, সেই আকাশে পৌঁছানোর সিঁড়িটিও ছিল আমার বাবা নিজেই। তার কাঁধ ছিল আমার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
সেই মানুষটা কতবার ভোর হওয়ার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। আমার জ্বর হলে রাতভর বিছানার পাশে বসে থেকেছেন—একবারও বলেননি “ভয় পেয়েছি”। তবু চোখের কোণে জমে থাকা ক্লান্তির রেখা সে কথাই বলে দিত।
কতদিন হেঁটে বাসায় ফিরেছেন—শুধু কোচিংয়ের ফি জোগাড় করতে। কখনো বলেননি, “আমি কষ্টে আছি।” তার জীবনজুড়ে শুধু ছিল আমাদের জন্য নিঃশব্দ ত্যাগ। আমার বাবাকে কোনোদিন “ভালোবাসি” বলা হয়নি। বলা হয়নি, “তুমি না থাকলে আমি, আমি হয়ে উঠতাম না।”

অথচ আমার প্রতিটি অর্জনের পেছনে যতটা না আমার শ্রম, তার চেয়েও বেশি ছিল তার ছেড়ে দেওয়া সুযোগ, তার জমানো কষ্ট, তাঁর সীমাহীন ধৈর্য।
আজ তার বয়স বেড়েছে, শরীর ক্লান্ত, অসুস্থ। জানি, তিনি চান আমরা সন্তানেরা তার চোখের সামনেই থাকি। আমাদের দেখে তিনি সাহস পান। কিন্তু আমরা—এই যান্ত্রিক জীবনে সময় বের করতে পারি না, কথা বলতে পারি না, পাশে দাঁড়াতে পারি না।
অনেক সময় মনে হয়—সময়টাকে যদি একটু পেছনে নিতে পারতাম! যদি আর একবার বলতে পারতাম— “বাবা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”

যাদের বাবা এখনো জীবিত আছেন, দয়া করে দেরি করবেন না। হয়তো তিনি আবেগ দেখান না, খুব বেশি কথা বলেন না। তবু জানবেন, তার বুকের ভেতর জমে থাকা ভালোবাসার পরিমাণ কোনোদিন কমেনি।
বাবারা আমাদের নায়ক। চোখে অদৃশ্য মাথার মুকুট, হাতে নিঃস্বার্থ ত্যাগের তালিকা, মুখে কঠিন অভিব্যক্তি, আর বুকে জমে থাকা গভীর ভালোবাসা। তারা কখনো নিজের গল্প বলেন না। তাদের গর্ব—শুধু আমাদের এগিয়ে চলা।
আজ বাবা দিবস। বাবা-মাকে ভালোবাসার জন্য আলাদা কোনো দিনের প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসা উচিত প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। তবু এই দিনটি হোক উপলক্ষ—একটু থেমে স্মৃতি হাতড়ে দেখার, কিছু না বলা কথা বলার, পুরনো ছবি খুলে চোখ ভেজানোর। বুকের কাছে "বাবা" নামটা টেনে এনে বলার— “তুমি না থাকলে, আমি আমি হয়ে উঠতাম না।”

যাদের বাবা নেই, তাদের কাছে দিনটি হয়তো ভারী। তবু বিশ্বাস রাখুন, তার ছায়া, তার শিক্ষা, তার আদর্শ এখনো আপনাকে আগলে রেখেছে।
আজকের দিনটা হোক হৃদয়ে ‘বাবা’ নামক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতাকে নতুন করে জড়িয়ে ধরার দিন।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শিল্পপুরাণ
এনএম

