চুল নিয়ে গল্প-কাব্যের শেষ নেই। বলা হয় একজন মানুষের শারীরিক সৌন্দর্যের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে চুল। আর তাইতো মাথায় টাক পড়লে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। টাক ঢাকতে নানা তেল, ওষুধ ব্যবহার করেন তারা। তাতেও কাজ না হলে বেছে নেন হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা চুল প্রস্তিস্থাপনের পদ্ধতিকে। তবে এই কাজটি কি মৃত্যুর কারণ হতে পারে?
সম্প্রতি টাক মাথায় চুল গজাতে গিয়ে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করিয়েছিলেন দুই প্রকৌশলী। অস্ত্রোপচারের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই তারা মৃত্যুবরণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাই সবার মনে প্রশ্ন জাগছে বিষয়টি নিয়ে। চলুন এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাক-
বিজ্ঞাপন
হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট কী?
হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট হলো জনপ্রিয় সার্জিক্যাল পদ্ধতি। টাক মাথায় নতুন করে চুল গজাতে এই সার্জারি করা হয়। মাথার ফাঁকা জায়গায় চুল গজানোর এই পদ্ধতি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তরুণ থেকে শুরু বৃদ্ধ— অনেকেই হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাচ্ছেন।

সাধারণত লোকাল অ্যানাসথেসিয়া দিয়ে মাথার ত্বককে অসাড় করে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় এই প্রক্রিয়া। অনেকসময় জেনারেল অ্যানাসথেসিয়া দিয়েও ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। অ্যানাসথেসিয়া এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এতে ব্যথা অনুভূত হয় না।
বিজ্ঞাপন
কীভাবে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়?
কসমেটোলজিস্টের মতে, স্ক্যাল্পের যেখানে হেলদি হেয়ার ফলিকল আছে, সেই জায়গাকে আগে চিহ্নিত করা হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় সেই জায়গাকে বলা হয় ডোনার এরিয়া। এবার এই জায়গা থেকে ফলিকল নিয়ে টাকের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়। কিছু মাস পরে সেই জায়গায় নতুন চুল গজাতে শুরু করে। হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের মূল পদ্ধতি এটাই। সহজ ভাষায় বলা যায়, টাক মাথায় যে অংশে চুল হয় সেখান থেকে চুল তুলে ফাঁকা স্থানে গেঁথে দেওয়া হয়। আর যেখান থেকে চুল নেওয়া হয় সেখানে পরবর্তীতে স্বাভাবিক নিয়মে আবার চুল গজায়।
মূলত অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়ার রোগীদের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চুল গজানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট কি নিরাপদ?
চিকিৎসকের মতে, হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট একটি সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া। তাই এর আগে অবশ্যই জেনারেল হেলথ চেক আপ জরুরি। এছাড়া অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া আছে এমন রোগীদের বয়স ৩০-৫০ এর মধ্যে হলে তবেই হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। সতর্কতা মেনে না চললে বিপদ হতে পারে।
যেসব রোগ থাকলে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা উচিত নয়:
হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট কিন্তু যে কেউ করাতে পারেন না। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং অটোইমিউন ডিজিজ থাকলে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের কথা মাথাতেও আনা উচিত নয়। এছাড়াও হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট খুব সেনসিটিভ একটি পদ্ধতি। কেবলমাত্র জেনারেল, প্লাস্টিক এবং ওরাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জেনরাই এই পদ্ধতি করতে পারেন। এই বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। পাশাপাশি এর ওপর ডিগ্রি থাকলে তবেই তারা হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে পারবেন।
যেখানে কাজটি করা হবে সেখানে যথাযথ ডে কেয়ার ফেসিলিটি থাকতে হবে। ওটি বেড, লাইট, ইমার্জেন্সি ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, পোস্ট অপারেটিভ রিকভারি রুমসহ নানা সুবিধা থাকা জরুরি। সঙ্গে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট পদ্ধতির বিষয়ে দক্ষ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের একটা টিম থাকতে হবে। অপরিচিত বা অদক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে ভুলেও হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাবেন না।

হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের ক্ষতিকর দিক:
হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের পর বেশ কিছু জটিলতা দেখা যায়। ব্যথা, চুলকানি তো আছেই। সেসঙ্গে ট্রান্সপ্ল্যান্টের জায়গা ফুলেও যেতে পারে। হতে পারে সংক্রমণ। সঙ্গে স্নায়ু নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও থেকে যায়।
অনেকসময় হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট থেকে মুখের ফোলাভাব বা ইডিমাও দেখা যায়। ট্রান্সপ্ল্যান্টের ৩ দিন পর এমন ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। তবে ট্রান্সপ্ল্যান্টের দিন বা তার পরের দিনেই যদি মুখ ফুলতে শুরু করে তাহলে তা অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন ধরে নিতে হবে। অ্যালার্জির কারণে শুধু মুখ ফুলে লাল হয়ে যায় না। এর সঙ্গে শ্বাসের সমস্যা, রক্তচাপ কমে যেতে পারে। অ্যানাসথেসিয়া, অ্যান্টিবায়োটিক বা পেইনকিলার থেকে এমন অ্যালার্জি দেখা যায়।
ভয় থাকে এসব নিয়েও
হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের কারণে ফলিকুলাইটিস হতে পারে। অনেকের হঠাৎ হঠাৎ করে হেচকিও ওঠে। কখনো কখনো লোকালাইজড ইনফেকশন সঠিক সময়ে সারিয়ে না তুললে সেপ্টিসেমিয়াও হতে পারে। যদি তা খুবই বিরল। এদিকে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের সময় বিভিন্ন জিনিস থেকে এই সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। যথাযথ হাইজিন মেনে না চলা, জীবাণুমুক্ত না করা সার্জিক্যাল টুলস ব্যবহারের কারণেই এমনটা হয়।

হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের কারণে কি মৃত্যু হতে পারে?
চিকিৎসকদের মতে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের কারণে মৃত্যু হয়েছে, এমন ঘটনা খুব কমই দেখা গিয়েছে। তবে এই আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, অ্যালার্জিক রিয়্যাকশনের (অ্যানাফিল্যাক্সিস) সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে তা থেকে বাড়াবাড়ি হতেই পারে। তখন কিছু ঘণ্টা বা একদিনের মধ্যেও মৃত্যু হতে পারে।
এনএম

