মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভ্রমণ কাহিনি

সুন্দরবনে বৃষ্টি বিলাস   

জাকিয়া সুলতানা
প্রকাশিত: ০৮ মে ২০২৫, ০৩:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

sundarban tour

খুব একটা কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। কিন্তু মন সব সময় আনচান করে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে। বছর কয়েক যাবত স্কুলের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘুরতে  যাওয়ার পরিকল্পনা বেশ কয়েকবার করা হয়েছে। যদিও শেষমেশ আর যাওয়া হয়ে উঠে নাই। গতবছরের ১২  হঠাৎই বান্ধবী মোনার ফোন রাত ১১ টার দিকে, বললো ঘুরতে যাবি? সে জানে আমাকে বললেই রাজি হয়ে যাব। এমনটাই ঘটলো, তার প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম না কোথায় যাচ্ছি? কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধু ইয়ামিন গ্রুপ খুলেছে ‘ঘুরতে যাবি’ নামে। সেখানে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধব দেখলাম অ্যাড হয়েছে। ওখানে সবাই মিলে ঠিক করা  হলো সিলেট যাব। কিন্তু পরের দিন প্লান পরিবর্তন হলো। সিলেটের পরিবর্তে সুন্দরবন যাচ্ছি আমরা।

ভ্রমণের পরিকল্পনা করতেই শরীরে যেন শিহরণ বয়ে গেল। এতো দ্রুত সুন্দরবন দেখা হবে ভাবি নাই কখনও। ঠিক হলো সাত জন যাচ্ছি আমরা। এক বন্ধু তার স্ত্রীকে সঙ্গে নেবে। দুই বন্ধু তরিকুল ও ইয়ামিন সঙ্গে যাচ্ছে। আরও এক বড় ভাই এবং আমি ও মোনা যাচ্ছি। 


বিজ্ঞাপন


inner
 
ঠিক হলো একদিন পরেই রওয়ানা দিব। সকালে রওনা দিতে পারলে ১১ টার মধ্যে মোংলা বন্দর পৌঁছাতে পারব। সেখান থেকে আগে থেকে ঠিক করে রাখা আমাদের রির্সোটের লোক নিতে আসবে। তারা নদী পথে নিয়ে যাবে রির্সোটে। 

রিসোর্ট বুকিং দেওয়ার জন্য আগে থেকেই টাকা পাঠাতে হবে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাপ অর্থ পাঠিয়ে দিলাম। অনুমান করা হলো জন প্রতি পাঁচ হাজারের মতো খরচ পরবে একদিনের ভ্রমণে। 

সুন্দরবনের কথা ভেবে সেই রাতে ঘুম হয় নাই কারো। আরো একটা রাত কি করে কাটাব?। পরদিন বিকেলে সবাই ঠিক করলাম আজ রাতেই যাব, সকালে না হয় আমরা নিজেদের মতো করে মোংলা ঘুরব। 

4


বিজ্ঞাপন


তবে তারপর থেকেই ফেসবুকের নিউজ ফিডে  চোখে পড়ে কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার কথা। তিন নম্বর বিপদ সংকেত চলছে। কেমন  ভয় এসে গিয়েছে মনে, তবে কি এবার ও যাওয়া হবে না আমাদের? দুর্যোগ ঘনিয়ে আসার আগেই বাসা থেকে বের হব ঠিক করলাম। যা হবে দেখা যাবে পরে। অবশ্য যে রিসোর্টে যেয়ে উঠব সেখানে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম সুন্দরবনে আবহাওয়া কেমন? তারা আমাদের ভরসা দেন যেতে। তারা আমাদের সকাল ১২টার দিকে মোংলা থেকে লঞ্চে করে রিসোর্টে নিয়ে যাবেন।

রাত ১১টা ৩০মিনিটের দিকে নবীনগর থেকে বাস ছেড়ে যাবে। সেই বাসে মোনা আর তার বড়  ভাই আসতেছেন। তবে ঠিক যাওয়ার আগ মুহূর্তে জানা গেলো বন্ধু আলামিন আর ওর সহধর্মিনী যাচ্ছে না। তরিকুল, ইয়ামিন আর আমি নবীনগর থেকে বাসে উঠব, বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। আম্মু গ্রামের বাড়িতে ছিলেন, ফোন করে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আব্বুর জন্য রান্না করেও রাখলাম। সে যেনো বাসায় এসে খেতে পারেন। তারপর আব্বুর সঙ্গে দেখা করে বেড়িয়ে পরলাম। ৪৫ মিনিট বাস  টার্মিনালে  অপেক্ষা করার পর বাস আসল। আমরা কিছু চিপস ও পানীয় কিনে বাসে উঠলাম। উঠেই মোনার সঙ্গে আলিঙ্গন করা। প্রায় আট মাস পর মোনার সঙ্গে দেখা। মোনা বাসা থেকে অনেক কিছু রান্না করে  এনেছিল। তখনই কিছু খাবার চেখে দেখলাম। কিছুক্ষণ সবাই হৈচৈ করলাম, হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাসের মতো। বাস ফেরিতে উঠলে সেখানে মোনার রান্না করা খাবার খেলাম। তারপর ক্লান্ত হয়ে মোনার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরলাম।      

7      

সুবহে সাদিক হতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। চোখ মেলে বুঝতে পারলাম কাছাকাছি চলে আসছি। খুলনার নৌবাহিনীর অফিসের পাশ দিয়ে বাস চলছে। দুইপাশে উঁচু উঁচু ছোট টিলা, বৃষ্টিতে ভেজা স্বচ্ছ আকাশ। ঠান্ডা বাতাসের পরশ চোখে মুখে ঝাপটা দেয়। আর তাতে বুঝলম রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। মন থেকে ভয় কাটলো বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবহাওয়া ভালো ঘুরতে আর বাঁধা রইল না। একাই গাড়ির জানালা দিয়ে এসব দৃশ্য দেখছিলাম আর মনে মনে কত কিই না ভাবছিলাম। বাকিরা সবাই ঘুমে। মিনিট ২০ এর মধ্যে  মোংলা বন্দরে পৌঁছে গেলাম। সবাইকে ডেকে তুললাম,বন্দরে নামতেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি। 

আরও পড়ুন: নেপালের জনপ্রিয় ৫ দর্শনীয় স্থান 

একটা চায়ের দোকানে চা খেলাম। সঙ্গে পাউরুটি।  এর মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। চায়ের দোকান থেকে দৌড়ে একটা খাবার হোটেলে আশ্রয় নিলাম। ঘণ্টা খানিক ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি শেষে আকাশ ঝলমলে। ১১ টা বেজে ৩০ মিনিটে রিসোর্ট ইরাবতী থেকে লঞ্চ এসে গিয়েছে ঘাটে। লঞ্চের ডেকে সামিয়ানা টানানো। সেখানে বসার আসন দেখে আমি দারুণ উচ্ছ্বাসিত। রোমাঞ্চকর এক অনুভতি হচ্ছিল। 

এতদিন ব্যস্ততার কারণে ইন্টারনেট ঘেঁটে আর দেখা হয়নি সুন্দরবনকে, কীভাবেই বা যায় সেখানে তাও অজানা ছিল।

466

এদিকে ১৬ জন যাত্রী নিয়ে নদী পথে আমাদের যাত্রা। আবারও বৃষ্টি নামল। সামিয়ানা গুটিয়ে বড় দুইটি  ছাতা দিলো আমাদের। বাতাসে মোনার হাত থেকে ছাতা ছুটে উড়ে চলে যায় নদীর বুকে। আরও একটা ছাতার ব্যবস্থা করা হয়। ছাতার নিচে থেকে কি আর সুন্দরবন দেখা হয়? মোনা আর আমি ছাতা ভাঁজ করে রেখে দিয়ে নদীর দুইপাশের গোল পাতার সারিবদ্ধ গাছ ও গভীর আরণ্য অপলক চোখে দেখছিলাম, আর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিলাম। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী বলেই হয়তো,  আমেরিকার বিখ্যাত কবি  এমলি ডিকেনসন এর কবিতার  কিছু চরণ আওড়াছিলাম।

I taste a liquor never brewed
I taste a liquor never brewed—
From Tankards scooped in Pearl—
Not all the vats upon the Rhine
Yield such an Alcohol!

(আমি স্বাদ নেই এক মদিরার যা কখনোই বানানো হয়নি—
মুক্তার ঝাঁপিতে ভরা পাত্র থেকে আমি তা চুমুক দিই—
রাইন নদীর সব ভাটিও দেয় না এমন মাদকতা,
এ যেন এক অমৃত, স্বর্গের অ্যালকোহল!)

দেড় ঘণ্টা পর রিসোর্টে পৌঁছালাম, রিসোর্ট দেখে মন আরও ভালো হয়ে গেলো। ওরা শরবত পরিবেশন করে আমাদের স্বাগত জানাল। বৃষ্টি ভেজা কাপড়ে রিসোর্টের কিছু অংশ ঘুরে বেড়ালাম। নদীতে খেয়াল করলাম খুব দ্রুত পানি বাড়ছে। রুমে গিয়ে বেশ ভালো লাগছিল। গোলপাতার ছাউনিতে ঘরের চাল, মেঝেতে কাঠের তক্তার, রুমের দেওয়াল এবং জানালার কিছু অংশ কাঠের ও গোলপাতার। বাতাস আর বৃষ্টি গোলপাতার ডাল ছুয়ে  যাওয়ার সে কি শব্দের মিতালি। পাতায় পাতায় সে কি সুরের মূর্চ্ছনা। অশান্ত মন যেন শান্ত হয়ে যায়। 

5

ফ্রেশ হয়ে, জামা-কাপড় পরিবর্তন করে খেতে গেলাম। খাবার সব দেশীয়, সুস্বাদু। রিসোর্টের বাকি অংশটা ঘুরে দেখলাম সবাই। বারবার চোখ চলে যায় পানির কাছে। পানি না কমলে আর কোথাও যাওয়া হবে না। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি? পানি হু হু করে বাড়তে থাকল অল্প সময়ে। তবে এই বৈরি  আবহাওয়া যেন শাপে বর হয়ে এলো। এতো সুন্দর বৃষ্টি এর আগে উপভোগ করা হয়নি। আগামীতেও এমন বৃষ্টিতে সুন্দরবনে কাটানোর সুযোগ হবে কি না জানা নেই।

বিকেলে গোলপাতাদের পাতায় পাতায় গল্প শুনতে শুনতে মিষ্টি এক ঘুম দিলাম। সন্ধ্যায় সবাই এক সঙ্গে হলাম। মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক নেই, কটেজে বিদ্যুৎও নেই। রির্সোটটি হারিকেন ও রঙিন মোমবাতি দিয়ে চমৎকার সাজিয়েছে।

রাতে রিসোর্ট থেকে গানের আয়োজন করা হয়। খালি গলায় ভাওয়াইয়া, বাউল সংগীত কী অসাধারণ সন্ধ্যা  না ছিল সেদিন। রাতে ওরা বারবিকিউ পার্টির আয়োজন রেখেছিল, বেশ উপভোগ করেছি। আমাদের মতো ঘুরতে আসা দুটো পরিবারের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।

8

আমরা রাতে আবারও এক হলাম। গানের কলি খেলি। আড্ডা দেই, ছোটবেলার কথা মনে করে হেসে লুটিয়ে পড়ি। একটা সময় সবাই চুপচাপ পশুর নদীর এপাশে বসে গভীর অরণ্যকে বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করি। তারপর সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমাকে স্মরণ করে ঘুমাতে যাই। গোলপাতার ছাউনিতে বৃষ্টি পড়ার ফোঁটা ফোঁটা মিষ্টি মধুর শব্দ মনে হলো যেন ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে কেউ ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।

এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর