একটা সময় সামাজিকতা বলতে পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, গল্প করা কিংবা কুশল বিনিময়কে বোঝানো হতো। বর্তমানে সেগুলো প্রায় পুরোটাই মুঠোফোন আর কম্পিউটারের মনিটরে আবদ্ধ হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিকতা রক্ষার সেতু। তবে প্রযুক্তির এই অগ্রগতি কি কেবল সুফলই বয়ে এনেছে? নাকি খারাপ প্রভাবও ফেলছে আমাদের জীবন ও মানসিকতায়?
প্রথমেই বলা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া কোনগুলো। সোজা কথায় অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় যে প্ল্যাটফর্মগুলো আমরা ব্যবহার করি সেগুলো সবই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। হতে পারে সেটা ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রাম, রেডিট কিংবা এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা টিকটক।
বিজ্ঞাপন

সোশ্যাল মিডিয়া এবং কমিউনিটির ভালো দিক
একজন ব্যক্তির জন্য কম সময়ে সমমনা অসংখ্য মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার সহজ মাধ্যম কমিউনিটি কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া। এখানে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন যে কেউ। অন্যের মতও নিতে পারে। একই বিষয় নিয়ে আর দশজন মানুষ কী ভাবছেন তা জানতে পারেন কম সময়েই।
নিজের মতাদর্শের সঙ্গে মেলে এমন মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক একজন মানুষকে বাঁচতে শেখায়, জীবনের দুঃখগুলো একপাশে রেখে সুখী হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। অন্তত একাকীত্ব দূর করতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞাপন

অন্যদের সঙ্গে মজা করা বা আনন্দে সময় কাটানো অবসরের একটি রূপ। হোক সেটি সশরীরে কিংবা অনলাইনে। গবেষণা অনুযায়ী এভাবে অবসর কাটালে সহানুভূতি বাড়ে। এটি মানসিক চাপ কমায়, মনের জোর বাড়ায়। এমনকি এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
আজ থেকে ৩০ বছর আগে বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে তা তৎক্ষণাৎ জানতে ও দেখতে পারার কথা বিশ্ববাসী হয়তো কল্পনাও করতে পারত না। রেডিও আর টেলিভিশন ছিল তখন তথ্য জানার মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপট একদম ভিন্ন। এখন মানুষ বাংলাদেশে বসে লাইভে দেখতে পাচ্ছে আমেরিকার দাবানল। এশিয়ায় বসে প্রতি মুহূর্তে জানতে পারছে ইউরোপের হাড়ির খবর। অনুরাগীরা জানতে পারছে প্রিয় সেলিব্রেটি, শো, ব্যান্ড বা টিমের সর্বশেষ আপডেট।

এত সুবিধা থাকার পরও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়েছে। কারণ অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে থাকা অনেক বিষয়ই বিতর্কিত। অনেকক্ষেত্রেই যা মনের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে। সবার সঙ্গে যুক্ত থেকেও মানুষ একা হয়ে পড়ছে। বদরাগী হয়ে উঠছেন। খিটখিটে মেজাজি হয়ে যাচ্ছেন। ভুলছেন বাস্তব জীবনের সামাজিকতা।
সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে?
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে উচ্চ মাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার হতাশা বাড়াচ্ছে। এটি কিশোর ও বৃদ্ধদের সামগ্রিক সুস্থ থাকার পথেও বাধা সৃষ্টি করছে। জামা নেটওয়ার্কে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের সঙ্গে স্বাস্থ্যের একটি খারাপ দিকের সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। এটি হলো- বিরক্তিকরতা।

শব্দটি একটু অন্যরকম লাগছে তাইতো? বিরক্তিকরতা বলতে এমন একটি মানসিক অবস্থাকে বোঝানো যখন ব্যক্তির মনে খালি নেতিবাচক আবেগ কাজ করে এবং রাগ ও বিরক্তির প্রবণতা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় কাটাচ্ছেন তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। যা ব্যক্তিজীবনের সম্পর্ক ও কর্মক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘদিন এমনটা চলতে থাকলে এমন ব্যক্তিদের হিংসাত্মক আচরণ এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
মন ওপর প্রভাব কমিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের উপায়
এখন ২০২৫ সাল। চাইলেই আপনি নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পুরোপুরি সরিয়ে ফেলতে পারবেন না। তারচেয়ে বরং কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার উপকারিতা গ্রহণ করা যায় সেই কায়দা জানতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতটা সময় কাটাবেন, কতগুলো পোস্ট দেবেন, কাদের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন সেগুলো আগে থেকেই প্ল্যান করে রাখুন।

কিছুক্ষণ পর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুঁ না মেরে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবহার করুন। এরপরের প্রশ্ন হচ্ছে কী করবেন? পছন্দের মানুষদের সঙ্গে চ্যাট করুন, প্রিয় সেলিব্রেটি বা সিনেমা বা শো’র রিলস দেখুন, মন চাইলে গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান কিংবা আনন্দ দেয় এমন কোনো ভিডিও দেখুন। সর্বশেষ খবরগুলোতে চোখ বোলান। ব্যাস, এতে আপনার মন থাকবে শান্ত আর আনন্দে ভরা।
গবেষণায় দেখা গেছে রাজনীতি সম্পর্কিত তথ্য, পোস্ট বা ভিডিও মানুষের রাগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে। আপনি যদি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকেন তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসংক্রান্ত কন্টেন্ট এড়িয়ে চলুন। চাইলেও অনেকসময় এড়ানো যায় না। বন্ধুতালিকায় থাকা কারো না কারো পোস্ট সামনে চলেই আসে। তবুও চেষ্টা করুন এড়ানোর। এতে মনের ওপর কম খারাপ প্রভাব পড়বে।

বেশিরভাগ মানুষ অবসর কাটাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। আপনিও কি তাই? তাহলে ব্যবহার শেষে প্রতিবার নিজেকে কিছু প্রশ্ন করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন- আমি কেমন অনুভব করছি? আমি যখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার শুরু করেছিলাম তখন থেকে কি এখন মন বেশি ভালো লাগছে নাকি বিরক্ত লাগছে? এটি কি আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করতে কাজে লাগছে?
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার জীবনের একটি ছোট্ট অংশ। মানসিক চাপ কমিয়ে আনন্দ পেতে দৈনিক কিছুটা সময় আপনি এর পেছনে ব্যয় করতেই পারেন। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হওয়া চলবে না। এতে মেজাজ খারাপ হবে, রাগ বাড়বে, অফলাইনের পরিচিতজনদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে।
তথ্যসূত্র: সাইকোলোজি টুডে ডট কম
এনএম

