সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পৃথিবীকে ফ্রেমে বন্দি করতে চান তারেক মাহমুদ

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২২, ১১:১২ এএম

শেয়ার করুন:

পৃথিবীকে ফ্রেমে বন্দি করতে চান তারেক মাহমুদ

চোখের সামনে একই জিনিস, অথচ একেকজন দেখছেন এক একভাবে। মানুষভেদে ভাবনাও আলাদা। বিশেষ করে যারা ছবি তোলেন তাদের কাছে সাধারণ জিনিসও ভিন্নভাবে ধরা দেয়। নিজের ভাবনা আর হাতের জাদুতে মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করেন তারা। ফটোগ্রাফার বা আলোকচিত্রী হিসেবে যাদের চিনি আমরা। এমনই একজন তারেক মাহমুদ। পেশাদার ফটোগ্রাফার  প্রকৃতির নানা রূপ যাকে মুগ্ধ করেছে অগুণিতবার। আর তার তোলা ছবি মুগ্ধ করেছে ভিনদেশিদেরও।  

খুলনার ছেলে তারেক। গ্রামের ধুলো গায়ে মেখে বড় হয়েছেন। ছেলেবেলায় পড়াশোনার প্রতি বেশ মনোযোগী ছিলেন। ক্লাসে প্রথম হওয়া, জেলায় প্রথম হওয়া, অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া- সবই ছিল অর্জনের ঝুলিতে। 


বিজ্ঞাপন


tarekপড়াশোনায় সবসময় মশগুল থাকতেন তারেক। এমনকি বিকেল বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যাওয়ারও সময় হতো না তার। খুলনায় মাধ্যমিক, শহরে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক শেষ করেন। এরপর মালয়েশিয়া প্রবাসী হন। সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং এন্টারপ্রেনারশিপের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার দেশে ফেরেন। 

কর্মজীবনের শুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় যুক্ত ছিলেন তারেক। বছরখানেক কাজ করেছেন ফ্রন্ট এন্ড ডেভেলপার হিসেবে। এরপর একবছর কাজ করেন একটি ক্রিয়েটিভ এজেন্সিতে। কিন্তু বাক্সবন্দি এই জীবনে আনন্দ খুঁজে পাননি তারেক। তাই চাকরি ছেড়ে দেন। ছবি তোলার শখকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। হয়ে ওঠেন পেশাদার ফটোগ্রাফার।  

tarekছবি তোলার আগ্রহ কীভাবে মনে জাগল? এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক বলেন, ‘নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। ছবি তুলতে ভালো লাগত। ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়াকালে গ্রামের এক ভাইয়ের কাছ থেকে তার রিল ক্যামেরা ধার নিয়েছিলাম। রিল কিনে ছবি তুলেছিলাম। যদিও সেই ছবিগুলো ডেভেলপ করিয়ে প্রিন্ট  করাতে পারিনি। সেসময়ে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল বের হলো। আব্বু বলেছিলেন, ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলে তা কিনে দেবেন।’

বাবাকে দেওয়া কথা রেখেছিলন তারেক। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। তার বাবাও কথা রেখেছিলেন। একটি ক্যামেরা মোবাইল ফোন কিনে দেন তারেককে। মাত্র ১.২ মেগাপিক্সেলের মোবাইল দিয়ে তারেকের ছবি তোলার সূচনা। সময়ের পালাক্রমে মোবাইল ফোন বদলেছেন। তবে মোবাইলের মডেল যাই হোক, ক্যামেরা কেমন সে ব্যাপারে ছিল সতর্ক দৃষ্টি। 


বিজ্ঞাপন


tarekবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তারেকের গণ্ডি বাড়ে, স্বপ্নগুলোও ডালপালা মেলতে থাকে। তখন তিনি ডিজিটাল ক্যামেরা কেনার স্বপ্ন দেখেন। কিছুদিন পর সাড়ে ৬ হাজার টাকা দিয়ে ডিজিটাল ক্যামেরা কেনেন। একসময় বুঝলেন, আরও ভালো ছবি তুলতে গেলে ডিএসএলআর ক্যামেরার প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য তো অর্থের প্রয়োজন। ক্যামেরা কেনার অর্থ জোগাতে পাগলামি করে বসলেন তারেক। এক সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে দিলেন। তাতে অবশ্য ৩৫ হাজার টাকা হয়েছিল। কিন্তু, ক্যামেরা কিনতে প্রয়োজন ছিল প্রায় ৬০ হাজার টাকা। 

ক্যামেরার বাকি অর্থ যোগাতে কোথাও যেতে রিকশায় না উঠে পায়ে হাঁটতেন।  বাড়তি কোনো খরচ করতেন না। এভাবে বেশ কিছু টাকা জমালেও ক্যামেরা কেনার জন্য আরও ৮ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল। এবার নিজের শখের মোবাইল ফোন বিক্রি করে দিলেন। ক্যামেরা কেনা হলেও মেমোরি কার্ড কেনার অর্থ ছিল না। বেচে দেওয়া মোবাইল ফোনের ১ জিবি মেমোরি কার্ড ছিল তার কাছে। ২০ টাকা দিয়ে কনভার্টার কিনে সেই মেমোরি কার্ড যুক্ত করেন ক্যামেরায়। তাতে অবশ্যই ১৫/২০টির বেশি ছবি সংরক্ষণ করা যেত না। 

tarekএরপর আর থেমে থাকেননি তারেক। চোখের সামনে যখন যা পেয়েছেন, ক্যামেরাবন্দি করেছেন। প্রকৃতি, মানুষ, জীবন সবই এনেছেন ফ্রেমে। তার ছবি তোলার প্রিয় বিষয় জানতে চাইলে তারেক বলেন, ‘আমি সব ছবিই তুলি। তবে ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় ল্যান্ডস্কেপ। অবশ্য এর পেছনেও রয়েছে এক মজার গল্প।’ 

তারেক জানান, মালয়েশিয়ায় থাকাকালীন রোজ নামের এক বন্ধুকে নিজের দেশ সম্পর্কে বলছিলেন। রোজ বাংলাদেশ না চেনায় তাকে গুগল করতে বলেন। গুগলে সার্চ দিয়ে বাংলাদেশের যে ছবিগুলো এসেছিল তার বেশিরভাগই মারামারি, দুর্ঘটনা কিংবা নেতিবাচক কিছু। অবাক হন রোজ। তারেকও বিব্রত হন। পরে তাকে বিউটিফুল বাংলাদেশ লিখে সার্চ দিতে বলেন। তখন বাংলাদেশের সুন্দর কিছু ছবি আসে। 

tarekতারেক বলেন, ‘বাংলাদেশের দুঃখ, দুর্দশা, দরিদ্র মানুষের জীবন ইত্যাদিকেই বেশিরভাগ ফটোগ্রাফার ছবি তোলার বিষয় হিসেবে বেছে নেন। এসব ছবি তুললে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতা সহজ হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃতি নিয়ে কেউ তেমন কাজ করে না। এখন অনেকে এই কাজটি করলেও, যে সময়ে আমি কাজ শুরু করি তখন তেমন কাউকে চোখে পড়েনি। এই ভাবনা থেকেই আমি ছবি তোলার ক্ষেত্রে প্রকৃতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম, চাঁদ, সূর্যাস্ত বা ফুল কত সুন্দর তা তুলে ধরতেই এই চেষ্টা বলতে পারেন।’

প্রকৃতির অগণিত সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দি করেছেন তারেক। তার তোলা ১০০ চাঁদের ছবি আর ১০০ বৃষ্টির দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ প্রশংসা কুঁড়ায়। 

tarekছবি তোলাকে সহজ ভাবলেও আসলেই বিষয়টি অতটা সোজা নয়। পছন্দসই দৃশ্যকে ফ্রেমবন্দি করতে প্রয়োজন যথেষ্ট ধৈর্য। ছবি তোলার গল্প বলতে গিয়ে তারেক জানান, একবার কুড়িগ্রামে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। ছবি তোলা শেষে শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। আশেপাশের ৩/৪ কিলোমিটারের মধ্যেও নেই কোনো বসতবাড়ি। পলিথিনে ক্যামেরা মুড়ে বৃষ্টিতেই দাঁড়িয়েছিলেন তারেক। একসময় হাঁটু পানি জমে যায়। চারপাশে ইঁদুর দৌড়াতে শুরু করে। পাট পচা পানিতেই দাঁড়িয়েছিলেন কয়েক ঘণ্টা। অবশেষে রাত ৯টার দিকে একটি নৌকার হদিস পান তিনি। 

এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতা রয়েছে তারেকের ঝুলিতে। অনেক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকসময় ঝুঁকি নিয়েও তুলেছেন ছবি। ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ফটোগ্রাফার, পরিবার বিষয়টি কীভাবে নিয়েছে? জানতে চাইলে তারেক বলেন, 'আমার বাবা সবসময় সন্তানদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই আমার পেশা বদলে পরিবারের কোনো আপত্তি ছিল না।’

tarekএকজন ফটোগ্রাফার সমাজে কেমন মূল্য পেয়ে থাকেন, জানতে চাওয়া হলে এই তরুণ কিছুটা বিমর্ষ হয়ে বলেন, ‘আমাদের সমাজে ফটোগ্রাফাররা এখনও সঠিক মূল্য বা সম্মান পুরোপুরি পাচ্ছেন না। এমনও হয়েছে যে ছবি তুলতে গেলে শুনতে হয়েছে কোন স্টুডিও থেকে এসেছি? স্টুডিওতে যারা ছবি তোলেন তাদের ছোট করছি না। কিন্তু আমাদের সম্মানটা যেন ঠিকঠাক পাই না। রাজধানীতে এখন একটু সম্মান মিললেও বাইরের চিত্রটা ভিন্ন।’

“একবার একটি এনজিওর ছবি তোলার কাজে সাতক্ষীরা গিয়েছিলাম। সেখানকার একটি দোকানে কফি অর্ডার করি। এমন সময় সেই দোকানদের ছেলে বলে উঠেছিল, ‘আসছে ছবি তুলতে, আবার কফিও খায়!’। হয়তো তাদের ভাবনা এমন যে, যারা ছবি তোলেন তাদের কফি খাওয়ার সামর্থ্য নেই।”- যোগ করেন তারেক। 

tarekহঠাৎ চাকরি ছেড়ে ফটোগ্রাফিতে মন দিয়েছিলেন তারেক। এই কাজটিকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বর্তমানে একটি এজেন্সি রয়েছে তার। আছে একটি প্রোডাকশন হাউজও। ৪/৫ জন তরুণের একটি দলও রয়েছে তারেকের। নিজের পেশাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিলেও এখনও অনেকের কাছে শুনতে হয় নেতিবাচক কথা। তারা ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে মানতে নারাজ। 

ঘুরতে ভালোবাসেন তারেক। অর্থের চেয়ে তাই সময় তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্য নির্দিষ্ট সময়ে অফিস করার চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই পেশায় আসেন। ইতোমধ্যে পুরো দেশও ঘুরেছেন। নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট তারেক। এই পেশা থেকে আয় কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আয় নির্ভর করে কাজের ওপর। মাসে নির্দিষ্ট কোনো আয় করা হয় না। তবে আমার ৬/৭ জনের একটা টিম আছে, অফিস আছে। সবার বেতন দিয়ে, অফিসের ভাড়া দিয়ে, ঘুরে বেড়ানোর মতো পর্যাপ্ত অর্থ থাকে বলতে পারেন।’

tarekভবিষ্যতেও ছবি তুলে যেতে চান তারেক। শত বছর পর তিনি না থাকলেও যেন তার তোলা ছবিগুলো থেকে যায়, সেগুলো যেন মানুষের প্রশংসা পায়- এমনটাই কামনা তার। 

এনএম/এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর