নারীদের সঙ্গে বেশ সহজেই জুড়ে দেওয়া যায় বন্ধ্যা বিশেষণটি। যেন এই সমস্যার দায় কেবল নারীর। অথচ বন্ধ্যত্বের সমস্যা হতে পারে পুরুষেরও। চিকিৎসকদের মতে, সমাজে যৌনতা নিয়ে যত বেশি অস্বস্তি থাকলে, এসব সমস্যা তত বেশি প্রকট হয়ে উঠবে। বিশেষত পৌরুষ আর সমাজে মুখ দেখানোর লজ্জার কারণে বেশিরভাগ পুরুষ এই সমস্যা লুকিয়ে রাখেন। আর দীর্ঘদিন অসুখ চেপে রাখার কারণে ধীরে ধীরে হানা দেয় অবসাদ। অথচ পুরুষের বন্ধ্যত্ব বা মেল ইনফার্টিলিটি একটি অসুখ মাত্র। সময়মতো সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
পুরুষের বন্ধ্যত্ব চিহ্নিত করা হয় কখন?
বিজ্ঞাপন
চিকিৎসকদের মতে, এক বছর ধরে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও যদি সন্তানধারণ সম্ভব না হয়, তবেই বলা যায় বন্ধ্যত্ব। ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের অসুস্থতা, ২০-৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীর অসুস্থতা এবং ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে দুজনের অসুস্থতাই বন্ধ্যত্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পুরুষের স্বাভাবিক প্রজনন মূলত দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। ১. সুস্থ ও স্বাভাবিক শুক্রাণুর উৎপাদন এবং যথাযথভাবে পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হওয়া (ইরেকশন), ২. বীর্য ও শুক্রাণুর নির্গমন (ইজ্যাকুলেশন) যাতে তা নারীদেহের ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হতে পারে।
যদি শুক্রাণুর মান কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় অথবা শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু নির্গমনের পথ সুগম না হয়, তখন বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে।
বিজ্ঞাপন
কী কী কারণে পুরুষের বন্ধ্যত্বের সমস্যা হতে পারে?
যৌনরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, অনেকসময় যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষমতাও বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। চিকিৎসার পরিভাষায় একে সেক্সুয়াল ডিসফাংশন বলে। এছাড়া থাকতে পারে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হওয়ার সমস্যা ও ইজ্যাকুলেশনের সমস্যাও। অনেকেই দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের সময় বিভিন্ন লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করেন। এগুলো শুক্রাণু নষ্টের কারণ হতে পারে। পুরুষের বন্ধ্যত্ব কেন হয় চলুন তার কিছু কারণ জেনে নিই-

অসুখ ও সংক্রমণ
মাম্পস বা এই জাতীয় সংক্রামক জ্বরের ফলে যদি শুক্রাশয় ফুলে যায় তাহলে সেখান থেকে শুক্রাণুর ক্ষতি হয়। পাশাপাশি শুক্রাশয়ে যক্ষ্মা হলে ভাস ডেফারেনস (শুক্রনালি দিয়ে শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু নির্গত হয়) রুদ্ধ হয়ে যায়। ডায়াবেটিস, ক্যানসার ইত্যাদি কারণেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবে দেহের অ্যান্টিবডি শুক্রাণুকে বিনষ্ট করে। শুক্রাণুতে সংক্রমণ হলে এর নড়াচড়ার ক্ষমতা লোপ পায়। ফলে বন্ধ্যত্ব অবধারিত।
হরমোনের সমস্যা
মস্তিষ্কের পিটুইটারি হাইপোথ্যালামাস গোনাগল অ্যাক্সিসে সমস্যার কারণে পুরুষ প্রজননের হরমোনগুলো যথাযথভাবে নিঃসৃত হয় না। সেখান থেকে শুক্রাণু উৎপাদন ও নিষেকের জাতীয় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

জিনগত সমস্যা
পুরুষ বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ এটি। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম’ যাতে ছেলেরা একটি অতিরিক্ত এক্স ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মায়। ‘সিস্টিক ফাইব্রোসিসের’ সমস্যায় অ্যাস্পার্মিয়া দেখা যায়। অনেকসময় জিনগত কারণে অনেক পুরুষের শুক্রনালি তৈরিই হয় না। একে কনজেনিটাল অ্যাবসেন্স অব ভাস ডেফারেনস বলে।
জন্মগত কারণ
অনেকেরই শুক্রাশয়ের গঠন ঠিক হয় না। তলপেট থেকে নীচের দিকে পুরোপুরিভাবে গঠিত হয় না সেটি। এই সমস্যাকে বলা হয় আনডিসেন্ডেড টেস্টিকুলার। পরবর্তীতে সেই শুক্রাশয় থেকে ক্যানসার ও বন্ধ্যত্ব সংক্রান্ত নানা সমস্যা দেখা দিতে পার। সুতরাং, পুত্রসন্তানের জন্ম দিলে নতুন মায়েদের অবশ্যই ছেলেদের শুক্রাশয় পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

অস্ত্রোপচার ও আঘাত
কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের সময় শুক্রনালিতে আঘাত লাগতে পারে। বিশেষত হার্নিয়া বা ওই জাতীয় অস্ত্রোপচারের সময়ে। আবার এই অঙ্গে কোনো আঘাত লাগলে সেখান থেকেও সমস্যা দেখা যায়। এমন একটি বিশেষ সমস্যার নাম ‘টরশন অব টেস্টিকল’। শুক্রাশয় সাধারণত নিলম্বিত অবস্থায় থাকে। অনেকসময় আঘাতের কারণে সেটি সম্পূর্ণ ঘুরে যায় (টুইস্টেড)। ফলে অসম্ভব যন্ত্রণা হয়, শুক্রাশয় ফুলে যায়। অস্ত্রোপচার ছাড়া এর চিকিৎসা নেই। শুক্রাশয়কে আবৃত করে রাখা স্ক্রোটামের শিরা উপশিরা ফুলে গেলে হয় ভেরিকোসেল। এটি অনেকটা পায়ের ভেরিকোজ ভেন অসুখটির মতো।
ওষুধ ও পেশাগত কারণ
শারীরচর্চার জন্য বেশি মাত্রায় স্টেরয়েড ব্যবহার করলে, অতিরিক্ত অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ও অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ খেলেও অনেকসময় বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত তাপ ও রেডিয়েশনের সামনে থেকে কাজ করা, মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান, কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত জীবনে অতিরিক্ত চাপের কারণেও বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা যায়।
শুক্রাণুর সমস্যায় চিকিৎসা শুরুর পর তা কার্যকর হতে প্রায় তিন মাস সময় লাগে। ন্যূনতম ২ কোটি শুক্রাণু না থাকলে সন্তান উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে।

চিকিৎসা কী?
রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসক সিমেন ও ব্লাড টেস্ট, আলট্রাসাউন্ড ও প্রয়োজনে টেস্টিকুলার বায়প্সি করাতে দেন। চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার ছাড়াও রয়েছে ইন্ট্রা-ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন, ডোনার ইনসেমিনেশন, ইন্ট্রা-সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন, টেস্টিকুলার স্পার্ম অ্যাসপিরেশন। কার কোনটি প্রয়োজন তা চিকিৎসক বলবেন।
বন্ধ্যত্ব একটি অসুখ মাত্র। এটি না লুকিয়ে চিকিৎসা করান।
এনএম

