বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ফেলনা টি ব্যাগে তুলির আঁচড়

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১৫ মে ২০২২, ০৩:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ফেলনা টি ব্যাগে তুলির আঁচড়

চারপাশে রঙ তুলি, ব্যবহৃত টি ব্যাগের খালি অনেকগুলো প্যাকেট ছড়ানো। আশেপাশে আরও কিছু ফেলনা জিনিস। এরই মধ্যে টি ব্যাগকে ক্যানভাস বানিয়ে তার ছোট্ট শরীরে তুলির আঁচড় কাটছেন এক তরুণ। নাম মো. সাদিত উজ জামান। টি ব্যাগে বিভিন্ন ব্যক্তি, দৃশ্য বা সামাজিক প্রেক্ষাপটের ছবি আঁকেন তিনি। পাশাপাশি ফেলনা জিনিস দিয়ে তৈরি করেন ব্যবহার উপযুক্ত পণ্য। এছাড়াও একজন প্রচ্ছদশিল্পী তিনি। একসময়ের শখই তাকে এনে দিয়েছে নতুন সব পরিচিতি। বর্তমানে তিনি ফ্যাশন হাউজের ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি টি ব্যাগে আঁকা, প্রচ্ছদ শিল্পী ও ফেলনা জিনিস দিয়ে নতুন কিছু তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। 

রাজশাহীর ছেলে সাদিত। জন্ম সেখানে হলেও তার বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকায়। মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন। এরপর বিবিএ এবং এমবিএ করেছন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চার বছর একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজও করেন। এরপর নাড়ীর টানে ফিরে যান রাজশাহীতে। বর্তমানে পরিবারের সঙ্গে সেখানেই আছেন তিনি। 


বিজ্ঞাপন


saditএকদম ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির পোকা সাদিতের মাথায় ছিল। মা-বাবা অনেক খেলনা এনে দিলেও দুই তিনদিনের বেশি তাতে আগ্রহ দেখাতেন না। একদিন ঘরে থাকা কাগজে কলম দিয়ে দুটো বৃত্ত এঁকে তার দুই পাশে দুটো দাগ দিয়ে বাবাকে দেখিয়ে সাদিত বলেন, ‘দেখো চম্মা’। স্পষ্ট কথা বলতে না শেখা ছোট্ট শিশুটির চশমা আঁকা দেখে বাবা বুঝলেন, এই ছেলের আগ্রহ কোথায়। পেন্সিল, খাতা এনে দেওয়া হয় তাকে। আঁকাআঁকি করে আনন্দে সময় কাটায় ছোট্ট শিশুটিও। 

ছোটবেলায় সাদিতের আরও একটি অভ্যাস ছিল। ফেলনা জিনিসপত্র দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করতে চেষ্টা করতেন তিনি। এই যেমন আইসক্রিমের কাপে এঁকে তা বানাতেন দেয়ালম্যাট। কখনোবা ডিমের খোসায় আঁকতেন প্রিয় কোনো দৃশ্য।  আঁকিয়ে ও প্রচ্ছদ শিল্পী সাদিতের আঁকাআঁকি বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। স্কুলের সাধারণ ড্রয়িং ক্লাসের বাইরে কারো কাছে আঁকা শেখেনওনি। নিজের মন আর মেধার সমন্বয়ে আঁকতে আঁকতে আঁকিয়ে হয়ে উঠেছেন তিনি। 

tea bagটি ব্যাগে আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে সাদিতের একটি ফেসবুক পেজ রয়েছে। যার নাম ‘টি ব্যাগ স্টোরিজ’। এমন একটি জিনিসকে ক্যানভাস বা ছবি আঁকার মাধ্যম হিসেবে কেন বেছে নিয়েছেন? জানতে চাইলে সাদিত বলেন, আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে আমি এমন কোনো মাধ্যম খুঁজে নিতে চেষ্টা করছিলাম যা আমার সন্তুষ্টির কারণ হবে, একইসঙ্গে অন্যদেরও ভাবিয়ে তুলবে। সাধারণ ক্যানভাস থেকে শুরু করে অনেক রিসাইকেল মাধ্যমেই কাজ করেছি। কিন্তু চাচ্ছিলাম একটি সহজলভ্য মাধ্যম যাতে ধারাবাহিক কাজ করতে পারি। সেরকম সময়ই শিল্পী রুবি সিলভিয়ার কিছু রিসাইকেল কাজ চোখে পড়ে। যার মধ্যে টি ব্যাগ আর্টও ছিল। মনে হলো, এমই কিছুর খোঁজেই ছিলাম আমি। আমার জানামতে তখনও আমাদের দেশে এই মাধ্যমটিতে কাজ করা হয়নি। তাই শিল্পাঙ্গনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে টি ব্যাগকেই মাধ্যম বানালাম।’

কেবল টি ব্যাগে আঁকা নয়। দেয়াশলাইয়ের খালি বাক্স, ওষুধের খালি পাতা, চিপসের প্যাকেট, কোমল পানীয়ের বোতল, ইনহেলারের খালি কন্টেইনার, হারপিকের ফেলনা বোতলের মতো জিনিস দিয়েও চমৎকার কিছু বানিয়েছেন সাদিত। তার হাতের জাদুতে কখনো চিপসের প্যাকেট হয়ে গেছে বাংলাদেশের মানচিত্র, হারপিকের বোতল হয়েছে পাখি। কখনো দেয়াশলাইয়ের বাক্সে এঁকেছেন তরমুজ। আবার ওষুধের খালি পাতায় এঁকেছেন প্রিয় কোনো ফুল। 


বিজ্ঞাপন


junkফেলনা জিনিস নিয়ে কাজ বা জাঙ্ক আর্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদিত বলেন, ‘টি ব্যাগ স্টোরিজের আগে থেকেই আমি জাঙ্ক আর্টের কাজ করি। মনের খোরাক জোগাতেই কাজটি করি বলতে পারেন। তবে একসময় মনে হলো পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদ করার একটি মাধ্যম হতে পারে জাঙ্ক আর্ট। মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে একটু সচেতন করার লক্ষ্যেই এমন কাজ করা বলতে পারেন।’ 

টি ব্যাগ হোক কিংবা ফেলনা কিছু- এসবে আঁকার বা তৈরির বিষয় নিয়ে ভাবারও তো একটা সময় লাগে। স্মিত হেসে সাদিত জানান কাজ নিয়ে ভাবার জন্য আলাদা সময় বরাদ্ধ রাখেন না তিনি। বরং হুট করে কিছু মনে আসলে তাই করে ফেলেন। এই যেমন ঘরে ছিল বাবার ব্যবহৃত নীল আর হালকা হলদেটে ইনহেলারের খালি কন্টেইনার। সাদিতের শিল্পীর দৃষ্টিতে তা দেখে মনে হলো টম আর জেরি। ব্যস, ভাবনা অনুযায়ী কাজ। ইনহেলারের বাতিল কন্টেইনার দিয়েই বানিয়ে ফেললেন সবার প্রিয় কার্টুন চরিত্র টম অ্যান্ড জেরিকে। 

সাদিতের বাড়ির সামনে একটা মস্ত বড় নারিকেল গাছ আছে। সম্ভবত এই গাছটি তার বেশ প্রিয়। ঝড়, মেঘলা দিন, জোছনাময় রাতের দৃশ্য তুলে ধরতে গাছটির ছবি তিনি টি ব্যাগে এঁকেছেন বহুবার। সে কথা থাকুক। বর্তমানে একজন প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে পরিচিত এই তরুণ। 

bookসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরেই এই কাজের সূচনা হয় তার। ফুয়াদ খন্দকার নামে টি ব্যাগ স্টোরিজের একজন ভক্ত একদিন তার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দেওয়ার অনুরোধ জানান সাদিতকে। প্রস্তাবে খুশি হলেও পারবেন কি পারবেন না নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। লেখকের অভয়ে তার দেওয়া থিম অনুযায়ী প্রচ্ছদ আঁকেন সাদিত। এরপর লেখক রুহুল আমীনের ‘মধ্যবিত্ত’ আর লেখক লুৎফর হাসানের ‘বগি নম্বর জ’ বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন এই শিল্পী। যা তাকে সবার কাছে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করে তোলে। সেই থেকে শুরু। বর্তমানে প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে একরকম হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। 

cardআঁকাআঁকি নিয়ে পাগলামি করতে ভালোবাসেন এই তরুণ। তাই, তার কাছে কাছের মানুষের আবদারও থাকে একটু ভিন্ন। এই যেমন, গত বছর বোন স্নেহার বিয়ে ছিল। ভাইয়ের কাছে বোনের আবদার ছিল হলুদের শাড়ি ভাইয়ের হাতে আঁকতে হবে। কাজটি করেনও সাদিত। পুরো শাড়িজুড়ে তুলে ধরেন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজা রানীর গল্প। আরও একটি অদ্ভুত কাজ করেন তিনি। বোনের বিয়ের কার্ডের নকশাও করেন নিজ হাতে। সেই কার্ডের ছবি দেখে পরবর্তীতে আরও কিছু মানুষ সাদিতকে অনুরোধ করেন বিয়ের কার্ডের নকশা করে দিতে। এই পর্যন্ত চারটি কার্ডের নকশা করেছেন। 

শৌখিন ও সৌন্দর্য পিপাসু অনেকেই সাদিতের কাছ থেকে তার আঁকা টি ব্যাগের চিত্রকর্ম কেনার ইচ্ছা পোষণ করেন। তবে এগুলো তিনি বিক্রি করেন না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, তাহলে কেবল শখের বসেই এত কাজ করা? কোনো আর্থিক লাভ নেই? 

এমন প্রশ্নের উত্তরে সাদিত হাসেন। বলেন, ‘মনের শান্তির জন্য কাজ করাই বা কম কী বলুন? তবে লাভ যে নেই তা কিন্তু নয়। দেশের স্বনামধন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছি আমি। এসব কাজ থেকে ভালোই আয় হয়। এছাড়া প্রচ্ছদ আঁকার বিষয়টির সঙ্গে আর্থিক সংযোগ রয়েছে। শখের বসে করলেও এই কাজগুলোই হতে পারে আয়ের ভালো মাধ্যম।’

tea bagকথায় কথায় জানা গেল, ইস্পাহানি মির্জাপুর চা, সিলন টি, বিকাশ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেছেন সাদিত। এছাড়া নিয়মিত কাজ করছেন বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের সঙ্গেও। এতে আর্থিক ও সামাজিক পরিচিতির দিক থেকে লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহককে দিতে পারছে ভিন্ন কাজের স্বাদ। 

বর্তমানে একজন সফল আঁকিয়ে সাদিত। এর পেছনে পরিবারের সর্বোচ্চ ভূমিকা আছেন বলে তিনি মনে করেন। সাদিত বলেন, ‘পরিবার হচ্ছে শক্তির আধার। এখান থেকেই যেকোনো ভালো কাজের শক্তি পায় একজন মানুষ। পরিবারে শান্তি থাকলে, পরিবার থেকে সাপোর্ট পেলে যেকোনো কাজেই একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে যায়। আমার পরিবার খুবই সাপোর্টিভ। পড়াশোনা থেকে শুরু করে পছন্দের কাজ সবক্ষেত্রেই আমার বাবা-মা আমাদের তিন ভাইবোনের মতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের ইচ্ছা আর পরিবার থেকে সমর্থনই আমাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে।’

saditটি ব্যাগ, ফেলনা জিনিস, বইয়ের প্রচ্ছদ, বিয়ের কার্ড সবকিছু নিয়েই কাজ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে কি অন্য কিছু নিয়ে সাদিতকে কাজ করতে দেখা যাবে? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে কাজগুলো আমি করেছি তার কোনোটাই পূর্ব পরিকল্পিত নয়। তাই, ভবিষ্যতে নতুন কিছু নিয়ে কাজ করবো কি না তার উত্তর আমার নিজেরও জানা নেই। হয়তো হ্যা, হয়তো না।’

এনএম/এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর