খুব ছোটকাল থেকেই আমি মা ন্যাওটা ছিলাম। বলা যায়, মা আমার সব সময়ের পৃথিবী ছিলেন। আমার রাগ, ক্ষোভ, ভালবাসা ও অভিমানের জায়গা। মাকে না দেখলেই আমার দম বন্ধ বন্ধ লাগতো। আমি ভাবতাম, মা মানেই সকল শক্তির উৎস, যারা অসুস্থ হন না কখনো। এই ভুল আমার প্রথম ভাঙলো যখন আমার ৭-৮ বছর বয়সকালে জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে মা বিছানায় শয্যাশায়ী হলেন। আমার ব্যক্তিত্বে আমার বাবার চরিত্রের কঠিনতা এবং মায়ের চরিত্রের কোমলতা দুই-ই আছে। ঠিক তাই বলে কিনা জানি না, আমি মায়ের কাছে যেতে পারছিলাম না। দিনরাত আমাদের পেছনে খাটুনি দেওয়া আমার মা বিছানায় কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে, এটা আমার শিশু মন মানতেই পারছিল না। আমি আঁড়চোখে মাকে দেখতাম আর কাঁদতাম। মহান আল্লাহর কাছে বারবার বিচার দিয়ে বলছিলাম, ‘আপনি আমার মাকে এমন কেন করলেন আল্লাহ।’
অল্প কিছুদিন পর মা সুস্থ হলেন, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি মা নেই। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে দৌড়ে ছুটছিলাম। ঘুম জড়ানো চোখে এক চাচীকে মায়ের মতো শাড়ি পরা অবস্থায় পেয়ে পেছন থেকে আঁচল ধরে টানছিলাম আর মা, মা করছিলাম। চাচী পিছন ফিরে হাসিমুখে আদর করতেই আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম, মা কোথায় বলে। আহা আমার ছোটবেলা, আহা সেই সময়। আমার সবকিছু আবদ্ধ ছিল মায়ের কাছেই। আমি মায়ের আঁচল পরিণত হয়েও ছাড়িনি। ওই আঁচলে আমার সব সুখ লুকিয়ে ছিল।
বিজ্ঞাপন
মায়ের মতো এমন পবিত্র মানুষ আমার জীবনে আমি কম পেয়েছি। প্রথম উপার্জনের টাকা দিয়ে মাকে একটা নীল শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম। প্রায়ই দেখতাম মা আমার দেওয়া শাড়িটা পরতেন। একদিন আমাকে বললেন, ‘বাহ তোর টেস্ট ভাল তো।’
পরিবারের সবার ছোট হওয়ায় সেই অর্থে আমার কিছু করতে হয়নি। বাবাকে হারালাম, আমার মায়ের চিরচেনা ছোট্ট গন্ডি আরও ছোট হয়ে গেলো। মা যেখানে থাকতেন আমি তার পাশেই থাকতাম। মাকে ছাড়া কোথাও থাকতে কষ্ট হতো। নিজেকে প্রবোধ দিতাম, বাবা নেই তো কি হয়েছে, আমার মা তো আছেন।
আস্তে আস্তে মায়ের বয়স বাড়তে থাকলো এবং তিনি শিশু হতে থাকলেন। অল্পতেই মানুষের দুঃখে কেঁদে দেওয়া এই মানুষ জগতের জটিলতা বুঝতেন না। স্পষ্ট কথা বলতেন। হঠাৎ মা আবার অসুস্থ হয়ে গেলেন। মা তখন হাসপাতালে, আমি অফিসে মন বসাতে পারছিলাম না। মায়ের কষ্ট হয়, আমার কষ্টের তীব্রতা আরও বাড়ে। সারাজীবন নামাজ পড়তে দেখা আমার মাকে হাসপাতালে ইশারায় নামাজ পড়তে দেখলাম। অনেক কথা বলতেন আমার ও আমার স্ত্রীর সাথে। কে জানে হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন হাতে বেশি সময় নেই।
মায়ের অসুস্থতা যখন প্রাথমিক অবস্থায় তখন আমি বিবাহিত ও আমার প্রথম বাচ্চার আগমনের প্রহর গুনছিলাম। সরকারি আবাসিক প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থায় অসুস্থতার দুঃসংবাদটি প্রথম শুনি। সাভারে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বসে চিৎকার করে কাঁদছিলাম, কেউ কিছু ভাবছে কিনা মাথায়ই ছিল না আমার।
বিজ্ঞাপন
আস্তে আস্তে মায়ের অসুস্থতা বাড়তে থাকলো, একটা মেজর অপারেশনের পর আমার মা আরও অসুস্থ হয়ে গেলেন। পুরোপুরি বাচ্চাদের মতো করতেন। হাসপাতালে আমার হাতে ছাড়া খেতে চাইতেন না। আমার একটু পৌঁছাতে দেরি হলে কষ্ট পেতেন। অন্য কেউ খাওয়াতে চাইলেও খেতে চাইতেন না। আমি খাওয়াতাম আর ভাবতাম, আমার মা আমার ছোট বাচ্চা হয়ে গেছেন। হাসপাতালের পাশেই মসজিদ ছিল কিন্তু আমি মায়ের সামনে তার রুমে নামাজ পড়তাম। আমাকে নামাজ পড়তে দেখলে মা অনেক সাহস পেতেন। আমি মহান রাব্বুল আলামিনকে দোয়ায় কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, ইয়া মাবুদ আপনি আমার কিছু হায়াত নিয়ে আমার মাকে আমার কাছে ফেরত দিন।
একদিন আসর নামাজ পড়ে সালাম ফেরানোর পর তাকিয়ে দেখি, মা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আমাকে দু’হাত বাড়িয়ে কাছে যেতে বললেন। আমার পুরো চেহারাটা ধরে ধরে চুমু খেলেন আর বললেন, ‘আমার বাবাটা একা একা সব সওয়াব কামিয়ে নিচ্ছে।’
মায়ের আঁচলে একটা কেমন সুঘ্রাণ ছিল, আমি মাঝে মাঝে মায়ের পাশে শুয়ে থাকতাম। শাড়ির আঁচলে সেই মা মা ঘ্রাণ আমাকে এখনও মাকে অনুভব করার শক্তি দেয়।
মা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সেদিন ছিল শুক্রবার। মা খুব আরামে ঘুমোচ্ছিলেন। মাগরিবের আজান দিতেই নামাজ শুরু করলাম, সালাম ফিরাতেই খেয়াল করলাম মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস কেমন যেন কমে কমে আসছে। চোখে পানি থাকায় আমি ভাবছিলাম ভুল দেখছি। পানি মুছতেই দেখি মায়ের ঘুমন্ত চেহারা একদম শান্ত হয়ে আছে। নিশ্বাস কেমন কম কম নিচ্ছেন। চিকিৎসক বললেন, তিনি আর নেই। আমার পুরো পৃথিবী মুহূর্তে দুলে উঠলো। মায়ের অসাড় দেহ নিয়ে বাবার কাছে ফিরছি আর দেখি বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, যেন প্রকৃতিও কাঁদছে।
আমার মায়ের আঁচলের শুভ্রতা, মায়ের সাথে কাটানো শেষ সময়গুলো আমাকে বেঁচে থাকার জীবনীশক্তি দেয়। শেষ সময়ে করা তার আদর আর দোয়া আমাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়। মাঝে মাঝেই মনে হয়, আর একটিবার যদি আঁচলের ওই শুভ্রতা সরাসরি অনুভবের সুযোগ পেতাম, সর্বোচ্চ উজাড় করে আমি সেই সুযোগটুকু নিতাম। আপনাকে পাগলের মতো ভালবাসি গো মা। আপনি আমাকে বলতেন— আপনি যেভাবে নিজের বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করেন, আমি হয়তো তেমন করবো না! বিশ্বাস করেন মা, এই ৮ বছরে কখনো আমার মোনাজাতে আপনি আসেননি এমন হয়নি। শ্বেতশুভ্র আঁচলে মহান তিনি আপনাকে নিশ্চয়ই অনেক ভালো রেখেছেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
ইফতেখায়রুল ইসলাম
এডিসি, ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড ফোর্স ডিভিশন
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)

