সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

অভিমান আর মায়ায় জড়ানো কিশোরীবেলার সেহেরি স্মৃতি 

আজমেরী সুলতানা ঊর্মি
প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

অভিমান আর মায়ায় জড়ানো কিশোরীবেলার সেহেরি স্মৃতি 

সেহেরিতে আমার বাবা পছন্দ করতেন আলু শিম একসাথে সিদ্ধ করে তারপর হাতে ডলে পেঁয়াজ কাঁচামরিচ কুচি আর খাঁটি সরিষার তেল মেখে যে ভর্তাটা করা হয় সেটা। তার সাথে পেঁয়াজ কাঁচামরিচ কুচি দিয়ে ভালো করে ফেটানো ফুলে ফেঁপে ওঠা ডিমভাজি। আম্মু করতো কী সাথে আবার টমেটো দিয়ে হাতে মাখা মসুরের ডাল ঘন করে রান্না করতো।

কিশোরী বয়স থেকেই আমার খুব রাত জাগার অভ্যাস ছিল। প্রথম রোজার শেষ রাতের খাবার নিয়ে সবার মধ্যেই অদ্ভুত আনন্দময় উত্তেজনা কাজ করতো। ছোট ভাইটা আগে আগে ঘুমিয়ে যেতো।যাতে সেহেরিতে উঠতে কষ্ট না হয়।


বিজ্ঞাপন


সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তাম আর অপেক্ষায় থাকতাম কখন দুইটা বাজবে আমি চুপি চুপি উঠে আগে আগে গরম ভাত রান্না করে সবাইকে চমকে দিবো! সেবার পানি কম হওয়ায় কড়কড়ে ভাতে আবার পানি দিয়ে শক্ত ভাতকে নরম জাউ ভাত করে ফেলেছিলাম। 

urmi1

আম্মু রাগে গজগজ করতে করতে বলছিল,কে তোকে মাতবুরি করে ভাত রেন্ধে সারপ্রাইজ দিতে বলেছে? ওদিকে আমার শিশুর মতো বাবাটা বলছিল আহা থাক থাক এটাই ভালো হয়েছে। শেষ রাতে সময় কম থাকে। নরম ভাত গিলতে সুবিধা,তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে যাবে।

কিশোরী আমি জাউ ভাত রান্নার লজ্জায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে বলতাম, আজকে আমি কিছু না খেয়েই কাল রোজা রাখবো। কেউ আমাকে ডাকবা না। আম্মু চোখ গরম করে বলতো আচ্ছা তুই ঘুমা।


বিজ্ঞাপন


কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়েই টের পেতাম রান্না ঘর থেকে ভেসে আসা ফুলানো ফাঁপানো গরম ডিম ভাজির ঘ্রাণ, যা কিনা আম্মু এইমাত্র কড়াই থেকে খুন্তি দিয়ে তুলে টেবিলের উপর হাফ প্লেটে রাখল। আব্বুর ছিলানো শিম আলু ভর্তায় পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কুচির সাথে সরিষার তেলের ঝাঁঝ, আর ধোঁয়া ওঠা মসুর ডালে টমেটো, ধনেপাতা কাঁচামরিচ ফালির সবুজমাখা সুগন্ধিতে মোটামুটি রাজকীয় অবস্থা। 

urmi2

পেটের মধ্যে ছুঁচোদের দৌড়ের কম্পিটিশন শুরু হয়ে যেত তখন। মনের মধ্যে কেবল একটাই ভয়, হায় হায় যদি আমাকে সত্যি সত্যিই কেউ ভাত খেতে ডাকতে না আসে! ওইতো ডাইনিং টেবিলে চেয়ার সরানোর শব্দ পাচ্ছি। ছোট ভাইটা আগে আগে বসে পড়েছে বোধহয়। কোন মায়াদয়া নাই বোনের জন্য।

ডিমভাজির মাঝের বড় মোটা টুকরোটা ওর পাতেই গেলো মনে হয়। ওকি! খাঁটি গাওয়া ঘি ঢালছে গরম ভাতে। আহ্ কি মিষ্টি সুগন্ধি! আম্মুর হাতের আলু শিম ভর্তায় এই ঘি ভাত। আমি তখন সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছি।

তারপর আব্বুর ঠান্ডা হাত আমার মাথার উপর কাঁথা সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,আয় রে মা আয় তো! সেহেরির সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে তো! ফজরের আযানের আগেই খাওয়া দাওয়া শেষ করে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। 

urmi3

আমি লক্ষ্মী সোনা মেয়ের মতো চুপচাপ বাবার পিছু পিছু খাবার টেবিলে চেয়ারে বসতাম। আম্মু আমার পাতে সবচাইতে মোটা ডিমের টুকরোটা তুলে দিতো। আব্বু খাঁটি ঘি আর শিম আলু ভর্তা দিয়ে বলতো, নে এবার খাওয়া শুরু কর। এক চামচ ঘন ডাল সাথে নিয়ে সেই নরম সুগন্ধি ভাতের লোকমাটাকে বেহেশতি কোন খাবার বলে মনে হতো।

আব্বু আম্মুর টুকরো টুকরো সংসারী কথা, ছোট ভাইয়ের ঘুম ঘুম চোখ আর আমার জাউ ভাত রান্নার আনন্দকে অলৌকিকভাবে মস্তিষ্কের সবচাইতে সুন্দর কোঠরে সাজিয়ে দিতো। সুবহে সাদিকের ওই অত্যাশ্চর্য সুন্দর সময়টায় আমার সেই আশ্চর্য সুন্দর পরিবারটিকে বেহেশতের একটা অংশ বলে মনে হতো। 

আহা সময়! সময়ের আবর্তে আমরা সবাই যার যার মতো ভিন্ন ভিন্ন জগতে চলে গেছি। শুধু প্রথম রমজানের সুবহে সাদিকের সেই সাদামাটা আশ্চর্য সুন্দর শেষ রাতের স্মৃতিময় গল্পটুকু বুকের খুব গভীরে তোলা রয়েছে। ঘুম না আসা মাঝরাতে প্রথম রোজার অপেক্ষায় থাকা আমায় সেই সব সাদামাটা গল্পের মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে আনে কেউ। টের পাই।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর