বস্ত্র বা পোশাক— মানুষের অন্যতম একটি মৌলিক চাহিদা। তবে সবার কাছে পোশাক কেবল লজ্জা নিবারণের বস্তু নয়। নিজেকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি পরিপাটি দেখানো কিংবা ট্রেন্ডের সঙ্গে চলার জন্যও অনেকে পোশাক বেছে নেন। এমন কিছু মানুষের কাছে পোশাকের পছন্দের প্রতিষ্ঠান ‘পশ এন ট্রেন্ডি’। এই অনলাইন প্রতিষ্ঠানটি স্বল্প সময়েই গ্রাহকদের পছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়েছে নিজেদের কাজের মাধ্যমে।
পশ এন ট্রেন্ডির স্বত্বাধিকারী ডা. উলফাত আরা জাহান প্রান্তী। উদ্যোক্তা এই নারীর সঙ্গে স্বল্প সময় আড্ডা হয় ঢাকা মেইলের। জীবনের নানা গল্প আর ব্যবসায়িক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
রংপুরের মেয়ে প্রান্তী। জন্ম আর বেড়ে ওঠা দুটোই সেখানে। স্কুল, কলেজ পার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। অর্থাৎ জীবনের একটা বড় অংশ রংপুরে কাটান প্রান্তী। কেমন ছিল শৈশবের সেই দিনগুলো? কোন স্মৃতিগুলো এখনও মাঝেমধ্যে মনে পড়ে? জানতে চাই তার কাছে।
প্রান্তীর ভাষ্য, ছেলেবেলা অসম্ভব সুন্দর ছিল তার। তিনবোনের মধ্যে ছোট তিনি। ছেলেবেলা থেকেই ভীষণ বড়বোন ঘেঁষা ছিলেন। সরকারী অফিসার বাবার শাসনে-আদরে শৈশব কাটিয়েছেন।
প্রান্তী বলেন, ‘প্রচণ্ড শাসনের মধ্যে আমার বোনরা ছিল স্বস্তির জায়গা। খুব হিসেবি জীবনযাপন ছিল আমাদের। কিন্তু আনন্দের কমতি ছিল না। সাদাকালো টিভিতে কতো যে বলিউড সিনেমা দেখেছি বোনদের সঙ্গে তার হিসেব নেই।’
বিজ্ঞাপন
আনন্দ অশ্রু মাখা চোখে ফের বলতে থাকেন, ‘আব্বু বাসায় না থাকলে ক্যাসেটে গান ছেড়ে দিয়ে নাচতাম আমরা তিন বোন। ইস, কত্তো সুন্দর ছিল দিনগুলো! আব্বু শখ করে আমাদের বাসার নাম রেখেছিলেন ‘ত্রিরত্ন নিলয়’। আশেপাশের সবাই আমাদেরকে ত্রিরত্ন নামেই চেনেন।’
ব্যক্তিজীবনের গল্প থেকে এবার ব্যবসায়িক জীবনে আসা যাক। পাশ করার পর মেডিকেল কলেজে ৫ বছর অ্যানাটমির শিক্ষক ছিলেন প্রান্তী। এর মধ্যেই ২০১৮ সালে শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। করোনার সময় চাকরিজীবনের ইতি টেনে পুরো মন দেন ব্যবসায়। বর্তমানে ব্যবসা আর পোশাক ডিজাইন করেই সময় কাটছে এই উদ্যোক্তা নারীর।
ব্যবসায় আসার ক্ষেত্রে সহকর্মীদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল উল্লেখ করে প্রান্তী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই নিজের জামা নিজে ডিজাইন করতাম। তিন বোন হাতের কাজও করতাম। যদিও পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে আব্বু করতে দিতেন না। ইন্টার্নির সময় প্রচুর ড্রেস ডিজাইন করতাম নিজের জন্য। সবাই খুব প্রশংসা করতো সেগুলোর। এরপর চাকরি, সংসার, বাচ্চা সব মিলিয়ে কোথায় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
‘অসম্ভব ভালো সব সহকর্মী ছিল আমার। তাদের উত্সাহেই মূলত ব্যবসা শুরু। স্বামীর প্রফিট বোনাস থেকে ১০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রথম পোশাক ডিজাইন শুরু করি’- যোগ করেন তিনি।
ব্যবসার শুরুর সময়গুলো কেমন ছিল? গ্রাহক থেকেই বা কেমন সাড়া মিলেছিল? জানতে চাইলে চিকিৎসক থেকে ব্যবসায়ী বনে যাওয়া প্রান্তী বলেন, ‘তখন আড়ং এর মতো কোয়ালিটি বা ভিন্ন নকশার পোশাকের প্রতিষ্ঠান অত বেশি ছিল না। প্রথম থেকেই অবিশ্বাস্য সাড়া পাই। কলিগ, সিনিয়র, জুনিয়র, ব্যাচমেট সবাই অর্ডার করতে থাকে। স্বামী আর মায়ের সাহায্য-উৎসাহে ধীরে ধীরে অর্ডারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এভাবেই শুরু বলতে পারেন।’
ভালোলাগার কাজে কোনো ক্লান্তি থাকে না। প্রান্তীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। প্রথম দিকে সবটাই নিজ হাতে সামলাতেন। অফিস শেষে ছোট্ট সন্তানকে সামলে যেটুকু সময় পেতেন তার পুরোটাই দিতেন ব্যবসায়। অবশ্য পরিশ্রমের ফলও পেতেন। কোনো পোশাকই অবিক্রীত থাকতো না তার। প্রথম থেকে এখন অব্দি এই ধারাই চলছে। এমনকি মাঝেমধ্যে গ্রাহকদের খালি হাতেও ফেরাতে হয় স্বল্প সংখ্যক পোশাক তৈরির কারণে।
মূলত দেশীয় তাঁতের কাপড় নিয়ে কাজ করেন প্রান্তী। তাঁতের সুতি, ভিসকস, জয়শ্রী সিল্ক, মসলিন কাপড়ে নিজস্ব ডিজাইনে পোশাক তৈরি করেন। এসব পোশাকের তালিকায় রয়েছে নারীদের থ্রি-পিস, কুর্তি, শাড়ি। এছাড়াও আছে পাঞ্জাবী আর শিশুদের পোশাক।
পশ এন ট্রেন্ডির যেকোনো ডিজাইনের পোশাক সংখ্যা খুব সীমিত থাকে, কিন্তু চাহিদা থাকে প্রচুর। খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও প্রতিষ্ঠানটির বেশিরভাগ ক্রেতাই রিপিট কাস্টমার। অর্থাৎ একের অধিকবার কেনাকাটা করেছেন এমন। বাজারে অসংখ্য পোশাকের প্রতিষ্ঠান থাকার পরও কেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি গ্রাহকের আলাদা আকর্ষণ কাজ করে?
এই বিষয় নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় পশ এন ট্রেন্ডির নিয়মিত গ্রাহক ঈশিতা পায়েলের সঙ্গে। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী এই নারী বলেন, ‘আমি এই প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই কেনাকাটা করছি বলা যায়। ক্রেতা হিসেবে আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট তাই যেকোনো উৎসবে এখান থেকেই পোশাক কিনি। ওরা ডিজাইন আর ট্রেন্ড দুটোই ভালো বোঝে। তাই একটা পোশাক কেনার কথা থাকলেও মাঝেমধ্যে বেশি কিনে ফেলি। স্বল্প কথায় পশ এন ট্রেন্ডিকে অনলাইন আড়ং বলা যায় ডিজাইন আর কোয়ালিটির দিক থেকে।’
‘আমার পরিচিত আরও অনেকেই এখান থেকে কেনাকাটা করে সন্তুষ্ট। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার প্রান্তী ভীষণ ভদ্র ও অমায়িক। সবদিক থেকে গুছিয়ে কাজ করেন তিনি। এমনকি অনেক সময় গ্রাহকরা কেমন পোশাক চাচ্ছেন বা কী রঙে চাচ্ছেন তাতেও গুরুত্ব দেন। ক্রেতার প্রতি এই সম্মানটুকু আমার খুব ভালো লাগে। সব মিলিয়ে আমার দৃষ্টিতে, বর্তমানে বাংলাদেশে অনলাইন পোশাক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম সেরা পশ এন ট্রেন্ডি’— যোগ করেন ঈশিতা।
একই প্রসঙ্গে প্রান্তী বলেন, ‘আমার পোশাকের ডিজাইনগুলো সম্পূর্ণ আমি নিজে করি। যে পোশাকটি ক্রেতা আমার প্রতিষ্ঠান থেকে কিনবেন সেটি আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কাপড়ের গুনগত মান নিয়ে আমি কখনো আপোষ করি না। তাঁতের কাপড়গুলো হাতে তৈরি হয়। তাই অনেকসময় রং ওঠা বা ফিনিশিংয়ের অভিযোগ আসে। গ্রাহকের মন্তব্য আমি হাসিমুখে গ্রহণ করে আরও ভালো করার চেষ্টা করি।’
মাত্র ১০ হাজার টাকা মূলধনে কাজ শুরু করেন প্রান্তী। বর্তমানে সম্মানজনক আয় করছেন এই উদ্যোক্তা নারী। ব্যবসা করতে এসে নানারকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। তবে ভালো অভিজ্ঞতার পরিমাণই বেশি।
প্রান্তী বলেন, ‘ডাক্তার কমিউনিটি থেকে আমি যে পরিমাণ সাপোর্ট আর উত্সাহ পেয়েছি সেটার জন্য আমি সবসময়ই কৃতজ্ঞ। আমি যেদিন ব্যবসার জন্য নিজের অফিস নিলাম, আমার বাবার চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। এটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। ব্যবসায়িক জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি।’
মেডিকেলে পড়াশোনা করে ট্র্যাক বদলে ব্যবসায়ী হয়েছেন। পরিবারের কি বাধা ছিল? উত্তরে প্রান্তী বলেন, ‘আমার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ আমার কাজে অনেক উৎসাহ দেয়। আমার হাজবেন্ড, বাবা-মা, বোন, দুলাভাই সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। কাজের প্রতি আমার ভালোবাসাকে তারা খুব খুব শ্রদ্ধা করেন।’
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে প্রান্তী বলেন, ‘এখন অনলাইনে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আলাদা কিছু করতে হবে। কোয়ালিটি নিয়ে কখনো কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। আর ক্রেতাদের প্রত্যেকটা অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনে নিজেকে আরও উন্নত করতে হবে। লেগে থাকার বিকল্প নেই। পরিশ্রম আর সততা থাকলে সফলতা আসবেই ইনশাল্লাহ।’
স্বপ্ন তো সবারই থাকে। প্রান্তীও স্বপ্ন দেখেন নিজের ছোট্ট একটা স্টুডিও থাকবে, যেখানে একপাশে পশ এন ট্রেন্ডির পোশাক সাজানো থাকবে। আর অন্যপাশে থাকবে চা খাওয়ার ব্যবস্থা। ক্রেতারা সেখানে আসবেন, কাপড় দেখবেন, গল্প করবেন, চা খাবেন।
সময় বয়ে যায় কিন্তু গল্প আর শেষ হয় না। তবু শেষ দুটো কথা শুনতে চাই প্রান্তীর কাছে। আবেগি হাসি মুখে তিনি বলেন, ‘ব্যবসাটা আমার কাছে সন্তানের মতো। আমার সন্তান যেমন আমাকে প্রথম “মা” ডেকেছে, তেমনি এই ব্যবসাটা আমাকে প্রথম নিজের একটা সুন্দর পরিচয় দিয়েছে। মেয়ে হয়ে আমি আমার বাবা-মায়ের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারি, এটা আমার জন্য সবকিছু পাওয়া।’
‘আমার হাজবেন্ড আমাকে এতো বেশি সাপোর্ট করেন যে তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সংসারের কোনো বাড়তি চাপ আমাকে নিতে হয় না। শান্তিমতো ব্যবসা আর ডিজাইনিং নিয়ে থাকি। সবাইকে নিয়ে এভাবে সুখে থাকতে চাই, এটাই দোয়া আল্লাহ্র কাছে’— যোগ করেন প্রান্তী।
সবার ভালোবাসা আর ভরসাকে সঙ্গী প্রান্তী আরও প্রসারিত করুক তার ব্যবসা। সৃজনশীল মন থেকে উৎপত্তি হোক নিত্যনতুন সব নকশা। এমনটাই প্রত্যাশা তার ক্রেতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের।
এনএম