রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইতিহাস

ডায়ানার কালো পোশাকটি কেন প্রতিশোধের প্রতীক হলো? 

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২৩, ১১:৪৪ এএম

শেয়ার করুন:

princess diana
ছবি: সংগৃহীত ও সম্পাদিত

১৯৯৪ সালের ঘটনা। জুনের এক পড়ন্ত বিকেল। গাড়ি থেকে নামলেন অনিন্দ্য সুন্দরী এক নারী। তার গন্তব্য লন্ডনের কেনসিংটন গার্ডেনের সার্পেন্টাইন গ্যালারিতে আয়োজিত ভ্যানিটি ফেয়ারের একটি পার্টি। গাড়ি থেকে নামতেই সব চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। ক্যামেরার শাটারে চলতে থাকল ক্লিক ক্লিক ধ্বনি। তার রূপের ছটায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন উপস্থিত সবাই। সুন্দরী এই নারীটি প্রিন্সেস ডায়ানা।

সাধারণত যেমন পোশাকে ডায়ানাকে দেখা যায় সেদিনের পোশাক ছিল তার চেয়ে ভিন্ন। তার পরনে ছিল কাঁধখোলা, আঁটসাঁট একটা কালো সিল্কের ককটেল ড্রেস। পোশাকটির পেছন দিকে ছিল লম্বা শিফনের ওড়নার মতো অংশ। বাতাসের তালে দোল খাচ্ছিল সেটি। 


বিজ্ঞাপন


diana1

পরের কয়েকদিন রাজপরিবারের সব বিষয় ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে সেই পোশাক। সাধারণ এক পোশাক হয়ে ওঠে প্রতিবাদের জলজ্যান্ত উদাহরণ। বিশ্ব গণমাধ্যম ডায়ানার সেই পোশাকটির নাম দেয় ‘রিভেঞ্জ ড্রেস’ বা প্রতিশোধের পোশাক। 

কালো পোশাকটিকে কেন প্রতিশোধের পোশাক বলা হয়?

১৯৮১ সালে প্রিন্স চার্লসকে বিয়ের মাধ্যমে রাজবধূ হন ডায়ানা। তাদের বিয়ের শুভক্ষণকে বর্ণনা করা হয় Fairytale wedding নামে। বিশ্বের প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন দর্শক টেলিভিশনে বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। প্রায় ৬০০,০০০ দর্শক রাস্তায় নেমে আসেন প্রিন্স এবং প্রিন্সেসকে এক নজর দেখার জন্য। সত্যিই কাল্পনিক এক বিয়ে ছিল এটি। 


বিজ্ঞাপন


diana3

তবে এত সুখের বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হলো না। চার্লস আর ডায়ানার সম্পর্কের রসায়ন ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই। আসলে ডায়ানার প্রতি সৎ থাকতে পারেননি প্রিন্স চার্লস। ডায়ানা যখন ছেলে আর স্বামী নিয়ে সংসার গোছাতে ব্যস্ত, চার্লস তখন প্রাক্তন প্রেমিকা ক্যামিলার প্রেমে মত্ত। 

বিবাহিত সম্পর্কের প্রায় এক যুগ পর ১৯৯২ সাল থেকে দুজনে আলাদা থাকতে শুরু করেন তারা। তখন থেকেই রাজপরিবার আর ডায়ানা হয়ে যায় দুই পক্ষ। তবে গণমাধ্যমের কাছে রাজপরিবারের চেয়ে ডায়ানার পাল্লা ছিল ভারী। তার জীবনযাপন, কাজ থেকে শুরু করে আউটলুক সবকিছু নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল বিশ্ববাসীর। 

diana2

সেদিনের পার্টিতে একটি ভ্যালেন্টিনো পোশাক পরার কথা ছিল ডায়ানার। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তেই নিজের মত বদলান তিনি। হাতে তুলে নেন কালো ককটেল ড্রেসটি। তিনবছর ধরে যা পড়ে ছিল তার ক্লজেটে। ডায়ানার জন্য পোশাকটি বানিয়েছিলেন তার ডিজাইনার ক্রিস্টিনা স্ট্যাম্বোলিয়ান। তবে ‘অতিরিক্ত সাহসী’ বা বেশ ছোট অজুহাতে পোশাকটি তখন এড়িয়ে যান ডায়ানা। সেই পোশাকটিই কেন তিন বছর বাদে পরেন প্রিন্সেস? কী ইঙ্গিত দেন তিনি এই পোশাকের মাধ্যমে? 

১৯৯৪ সালের সেই সন্ধ্যায় আসলে একটি নয়, বরং দুটি ঘটনা ঘটেছিল। ডায়ানা যখন প্রধান অতিথি হিসেবে পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন, একই সময়ে প্রিন্স চার্লস জাতীয় টেলিভিশনে বহু বছর পর একটি সাক্ষাৎকার দিতে বসেছেন। সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত?’ উত্তর দিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেন প্রিন্স। তারপর বলেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর একটু থেমে বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক এমনভাবে ভেঙে গেল কোনোভাবেই যা আর জোড়া লাগানো যায় না, এর আগ পর্যন্ত আমি স্ত্রীর প্রতি সৎ ছিলাম।’ 

diana5

এই কথার মাধ্যমেই চার্লস তার আর ক্যামিলার পরকীয়ার কথা পরোক্ষভাবে হলেও পুরো বিশ্বের সামনে স্বীকার করে নেন। অবশ্য অস্বীকারের কোনো পথও ছিল না। ততদিনের তাদের প্রেমের গুঞ্জন সবার জানা হয়ে গিয়েছিল। 

এরপরই ডায়ানার কালো পোশাকটিকে রিভেঞ্জ ড্রেস নাম দেওয়া হয় গণমাধ্যমে। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। রাজপরিবারের নারী সদস্যদের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মানতে হয়। তাদের কাঁধখোলা পোশাক পরার নিয়ম নেই। তাদের এমন পোশাক পরতে হয়, যাতে কোনোভাবেই ক্লিভেজ দেখা না যায়। হাঁটুর ওপরে দৈর্ঘ্য, এমন ছোট পোশাক পরাও বারণ। আর হাতে গ্লাভসও বাধ্যতামূলক। রাজপরিবারের সব নিয়ম ভেঙ্গেই সেদিন পোশাকটি পরেছিলেন ডায়ানা। 

diana4

হাঁটুর কম দৈর্ঘ্যের অফ সোল্ডার আর ক্লিভেজ দেখানো পোশাকটি পরে ডায়ানা যেন সেদিন রাজপরিবারের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলেন। এমন পোশাক পরা তার জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। অনেকে আবার বলেন চার্লসের পরকীয়ার কথা স্বীকার করার ব্যাপারটি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন ডায়ানা। তাই সেদিন একটু বেশিই কামনীয়ভাবে সেজেছিলেন। এ যেন চার্লসের উদ্দেশ্য বলা, ‘দেখ তুমি কাকে ফেলে যাচ্ছ! আমি সে যার সৌন্দর্যে অবাক হয় পুরো বিশ্ব’। 

১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট প্রিন্সেস ডায়ানা এবং প্রিন্স চার্লসের অফিশিয়ালি ডিভোর্স হয়। নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন ডায়ানা। ১৯৯৭ সালে, মৃত্যুর দুই মাস আগে, একটি এইডস হাসপাতালে দাতব্যকাজের জন্য নিজের ৭৯টি গাউন দান করেন তিনি। সেখানে ভ্যালেন্টিনো, ভারসাচে, ডিওরের সঙ্গে ছিল এই কালো পোশাকটিও। ৬৫ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয় সেটি। 

diana7

২০১৭ সালে আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত মিউজিয়াম অব স্টাইল আইকনে একটি প্রদর্শনীতে এই ‘রিভেঞ্জ ড্রেস’টি প্রদর্শিত হয়েছিল। ‘ডায়ানা: একজন ফ্যাশন উত্তরাধিকার’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল ডায়ানার ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে।  

১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসের ৩১ তারিখে রাত সাড়ে বারোটার কাছাকাছি সময়ে মার্সিডিজ এস-২৮০ ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্যারিসের অ্যালমা ব্রিজের নিচে টানেলের পিলারে সজোরে আঘাত হানে। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ডায়ানা, তার সঙ্গী দোদি ফায়েদ এবং গাড়ি চালক হেনরি পল।

diana8

মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় একমাত্র ডায়ানার দেহরক্ষী ট্রেভর জেনিস ছাড়া কেউ প্রাণে বাঁচেননি। তবে বহুবছর পেরিয়ে গেলেও ডায়ানা আজও বিশ্ববাসীর মনে জায়গা করে বেঁচে আছেন তার কর্মের মাধ্যমে। 

তথ্যসূত্র: পিপল ডট কম, রিডার্স ডায়জেস্ট, উইকিপিডিয়া, টাইম ম্যাগাজিন ইত্যাদি 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর