কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতার ভাষায় বলেছিলেন, ‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’। তার এই কথাই ধ্রুব সত্য। দ্যুতি ছড়ানো নক্ষত্র একদিন আলো হারায়, নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। বাংলা সাহিত্যের এমনই এক নক্ষত্র ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আজ থেকে ১১ বছর আগে নিভে গিয়েছিল যার জীবন প্রদীপ।
হুমায়ূন আহমেদ না থাকলেও তার অসংখ্য লেখা আর অগণিত পাঠক রয়েছে। যাদের কাছে এই কথাসাহিত্যিক অবিনশ্বর। নানা পেশার, নানা বয়সী মানুষ জানিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তাদের অনুভূতি।
বিজ্ঞাপন
হাসান জাভেদ বলেন, ‘আমার কাছে হুমায়ূন আহমেদ একটা শ্যাওলা জমা শান্ত শীতল দীঘি। সেই দীঘিতে ডুব দিলেই অসম্ভব শান্তি লাগে।

সৌমিত্র সৌম্যের কাছে হুমায়ূন আহমেদ শব্দের জাদুকর। এই তরুণ বলেন, ‘তিনি শব্দের জাদুকর, অনেকটা আমাদের ঘুম বেলার ঠাকুরমাদের মতো। উনি যা বলতেন আমরা চুপ করে শুনতাম, কল্পনায় আঁকতাম। তারপর একটাসময় সেই গল্পের মানুষটা হতে চাইতাম তীব্রভাবে। সেই ঘোরের এক প্রখর আকর্ষণ, যেটা মাথার ভেতর ঘুণপোকা হয়ে ঠুকতে থাকে, প্রতিদিন প্রতিক্ষণ।
এডেক্স গ্রুপের এইচআর এডমিন সফিকুল ইসলাম রাসেল বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদরা বার বার জন্মায় না। যুগে বা শতাব্দীতে এমন এক দুইজন জন্মায়। হিমু, মিশির আলী, বাকের ভাইয়ের মত অসংখ্য চরিত্রের স্রষ্টা। যিনি একটা প্রজন্মকে বই পড়া শিখিয়েছেন। ভালোবাসার ভিন্ন একটা মাত্রা তৈরি করেছেন। এমন লেখা আর লেখক আসবে কিনা সন্দেহ। আমার জীবনের আফসোস আমি এই জাদুকরকে দুই চোখে দেখতে পাইনি। কিছু কিছু আফসোস পূরণ হওয়ার নয়। আজন্ম বয়ে বেড়াতে হয়।’
বিজ্ঞাপন
সহকারী পুলিশ সুপার মানস কির্ত্তনীয়া নয়নের মতে, ‘বাংলাদেশের সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নিজের জীবনও প্রেম, কষ্ট এবং সমাজের সংঘর্ষের গল্প বোনা। বহুমুখী থিম এবং চরিত্রগুলি তিনি তৈরি করেছিলেন, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কথা তাকে অমরত্ব দিয়েছে। তার গল্পগুলি সময়ের সাথে যেমন বাঁক বদলেছে, তেমনি তার জীবনের উত্থান-পতনও তাকে লেখক হিসেবে পূর্ণতা দিয়েছে। সাহিত্যের আলিঙ্গনে তার জীবন যেমন পূর্ণতা পেয়েছে, লাখো ভক্ত তার সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদন করেছেন পূর্ণতা নিয়ে। তার প্রতিভা রয়ে গেছে অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে যা চিরকাল টিকে থাকবে।’

মনিতা সিনহা বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন লেখক যিনি পুরো একটা জেনারেশনকে বই পড়তে আগ্রহী করেছেন, বৃষ্টি ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, জোছনা ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটা বই পড়ার সময় হিমু, শুভ্র, মিসির আলি নয়তো রুপা হতে ইচ্ছে জেগেছে।
এম এইচ গ্রুপে কর্মরত মো. শাহীদুল ইসলাম শাহেদের ভাষায়, ‘শব্দের খেলায় মুখরিত অবসর সময়ের একান্ত সঙ্গীর কারিগর, যার যৌক্তিকতার সমান তালে চলতো তারুণ্যে ভরা বাউন্ডুলতা। বই বিমুখী থেকে করেছিলেন পাতায় নিমগ্নিত। মিসির আলী থেকে হিমু কিংবা এক রাশ ভালোবাসায় শুভ্র কিংবা নন্দিত নরকে বা কোথাও কেউ নেই। কিন্তু তিনি কোথায় নেই? নাটক, চলচ্চিত্র, উপন্যাস সর্বত্রই বিরাজমান ছিলেন এই গুণী মানুষ। আরও কিছু প্রাপ্য ছিল উনার কাছে।
মালয়েশিয়া প্রবাসী শাহনেওয়াজ সুমী বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর সমগ্র বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম । যিনি বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি মানব জীবনের অঙ্গনে তৈরি করেছেন জীবন রসগ্রাহী এক ভাব সত্যকে। তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক।
তার রচিত চরিত্রের মাঝে কেউ না কেউ নিজের উপস্থিতি পেয়ে যান। বাংলার ঘরে ঘরে হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন হিমু, রূপা, মিসির আলী ,শুভসহ অনেক চরিত্র হয়ে। তিনি এমন এক অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ যিনি জীবনের রসায়ন আর মনের রসায়নের সত্যগুলোকে খুব সহজ করে আমাদের জীবনবোধের অঙ্গ করে দিয়েছেন। তিনি অপ্রেমিক কে প্রেমিক হতে শিখিয়েছেন। তিনি মানুষকে সাধারণের মাঝে অসাধারণতা খুঁজতে শিখিয়েছেন। তিনি ছোট ছোট ফেলে দেয়া কথাগুলোকে মূল্যবান অলংকৃত করতে শিখিয়েছেন। তিনি বিলুপ্ত হওয়া সংস্কৃতির মূল ধরে টেনে উঠানোর পন্থা অবলম্বন করা শিখিয়ে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় লেখক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে গেছেন।’

মৌনতা শারমিনের কাছে হুমায়ূন আহমেদ একটু বেশি স্পেশাল। তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন স্যার কে যে কী পরিমাণ পছন্দ করি তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ইন্টারে থাকতে বাসায় বড় আপাকে বলতাম, আমি আর পড়াশোনা করবো না। হুমায়ূন স্যারের বাসায় কাজ করবো, বেতন নিব না। শুধু বলবো আমাকে থাকতে, খেতে দিতে আর বেতনের বদলে প্রতিমাসে তার বই দিতে।
তিনি ১৯ জুলাই চলে গেলেন। আমি সেদিন কাঁদিনি। কিন্তু ২৪ জুলাই তাকে দাফনের দিন আমি এশার নামাজে দাড়িয়ে এত কেঁদেছিলাম। সারা নামাজে আমার চোখের পানি আমার পায়ে টপ টপ করে পড়ছিল।
আর একটা অদ্ভুত বিষয় কী জানেন, ১৯ জুলাই তার মৃত্যুর দিন আর এই দিনেই আমি প্রথম মা হয়েছি দুই বছর আগে। আর ২৪ জুলাই তার দাফনের দিন আমার জন্মদিন। আমি খুব অবাক হই, এই দুই দিনই কেন আমার জীবনের স্পেশাল দিন।’
মো. শাহাদাতুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের মত রথী মহারথীদের উপন্যাস গল্প যখন বইমেলা লাইব্রেরি দখল করে ছিল তখন হুমায়ূন আহমেদ তাদের ভিড়ে নতুন পাঠক তৈরি করতে পেরেছিলেন। ভারতবর্ষে যদি একজন রবীন্দ্রনাথ থাকেন, আমাদের রয়েছে একজন হুমায়ূন আহমেদ।
নজরুল ইসলামের মতে, ‘বই পড়ার শুরু হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে। তিনি না থাকলে এদেশে আমার মতো বহু মানুষ পাঠক হতে পারতেন না। পাঠকের এবিসিডি হলো হুমায়ূন সাহিত্য।’

এনজিও কর্মী জনপল বলেন, ‘কলেজে পড়ার সময় ২০০২ সাল, হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের জন্য পাগল ছিলাম। মিসির আলীর অদেখা ভুবন দেখতে বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাত জাগা, হিমু হতে পার্কে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি, রুপাকে খুঁজে ফেরা কত কী!’
মো. মোসলেম রেজার কাছে হুমায়ূন আহমেদ প্রশান্তি নাম। তিনি বলেন, ‘হতাশা, বিষণ্ণতা, কিংবা মনখারাপ হলে উনার মাঝে ডুবে থাকি। সামান্যে খুশি থাকা, নিজেকে গুরুত্ব দেয়া বিলুপ্ত না হয়েও টিকে থাকার মন্ত্র উনার থেকে ধার করে নিয়ে চলছি।’
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ট্রাস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা ইউসুফ আহমেদ শুভ্র বলেন, ‘মিসির আলী, শুভ্র, হিমু, রুপা কিংবা পাতার বাঁশি বাঁজাতে জানা সেই সব লোকগুলো কেমন করে এমন বই বন্দি হয়ে গেলো! আহারে! আর কখনোই এরা নতুন করে কথা বলবে না, রিনিঝিনি শব্দে হাসবে না, খালি গলায় গাইবে না, অল্প কিছুতেই ভয় পাবে না, চন্দ্রগ্রস্ত হবে না, ভালোবাসবে না।
মিসির আলীর যুক্তি, শুভ্রর অদ্ভুত সারল্য, হিমুর অবিরাম যুক্তিহীন পাগলামি আর সেই পাগলটার জন্য নীল শাড়ী পরে রুপাদের অপেক্ষার আর কোনো গল্প আমি জানবো না। বুকের ভিতরটায় কেমন যেন অতি আপনজন হারানোর ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি। আহারে, আহারে!’
সাধারণ মানুষের এমন অনুভূতিগুলোই জানান দেয় কতটা কাছের ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কতটা ধার ছিল তার লেখনীর। তাই এখনও হয়তো হুমায়ূন আহমেদের পুরনো বইয়ের ভাঁজে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান অসংখ্য মানুষ।
এনএম

