প্রিয় বাবা,
জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা। দুদিন পর জুন মাসের বিশ তারিখ। সে কথা মনে আছে তোমার? না, মনে থাকবে কী করে? তুমি তো শুধু আমার কথাই ভাববে, তাই না! নিজের জন্য সময় কোথায় তোমার? ডাকাবুকো ছোট্ট সেই লাটিম বালকটা তোমার, আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। লোকাকীর্ণ তিলোত্তমা নগরীতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তে ব্যস্ত, তখনও তুমি মুদিত নয়নে কাজ করে যাও আমার খুশির জন্য। নিজের খেয়াল রাখবে কবে? আর শোনো, ঘুমিয়ে পড়ার আগে টাফনিল ওষুধটা খেয়ে নিও কিন্তু।
বিজ্ঞাপন
বাবা, আজকে কিন্তু ঘুমাব না আমি। মনের অবারিত খোলতা শব্দচিত্র দিয়ে লিখব তোমার কাছে। মনের গহীনে বরফজমা কথাগুলি জলস্রোত হয়ে আজকে স্পর্শ দিবে তোমায়। তোমাকে চিঠি লেখার এই মুহূর্তে খেংরামুখো জুনিপোকা আমার পাশে বসে কি বলে জানো? তুমি না-কি ঘুমের ঘোরেও আমার কথা ভাবো! জানো বাবা তোমার কাছে লিখতে গিয়ে বারবার কেঁদে ওঠে আমার উচাটন মন। রাতের জোনাক আমার চোখ মুছে দিয়ে কি বলে জানো? যার বাবা আছে, তার কী আবার কাঁদতে হয়! কিন্তু আমি যে কান্না থামাতে পারছি না বাবা। তুমি যে আমাকে ছিঁচকাঁদুনে বলতে, সত্যি সত্যিই আমি একটা ছিঁচকাঁদুনে।
বাবা, আমি বড় হয়েছি বটে কিন্তু তোমার কাছে লিখতে বসে নিজেকে তোমার সেই লাটিম বালকই মনে হয়। মনে পড়ে বাবা, বাইরে বের হতে গেলেই ছোট্ট এই আমি তোমার হাতটা ধরে বসে বায়না করতাম আমাকেও নিয়ে যেতে হবে। অবশেষে আমার জেদের কাছে হার মেনে আমাকে কোলে নিয়েই বের হতে হতো তোমাকে। জানো বাবা আজও ইচ্ছে করে তোমার আঙ্গুল ধরে হাঁটি। ইচ্ছে করে আবার হয়ে যাই তোমার সেই লাটিম বালক। তুমি ভালো থাকার ভান করলেও, আমি জানি আমাকে ছাড়া নিভৃতে একটুও ভালো থাকতে পারো না তুমি। এমন কেন করো গো বাবা! তুমি সেই ছোটকাল থেকেই বলে আসছ আমি নাকি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না, গুলিয়ে ফেলি কিছু বলতে গেলেই। তোমার সেই ছেলেটিই আজ লিখছে তোমার কাছে।
রাতের কর্ণফুলীতে সারিবাঁধা নৌকার লণ্ঠনের মতো আজও আমার হৃদয় আকাশে ঘুরপাক খায় তোমার মুখের হাসি। স্কুল থেকে ফিরতেই আমাকে দেখে তোমার মুখ চুইয়ে পড়া মুগ্ধতা লুকনো হাসি, আদর, ভরদুপুরে ঘুরে বেড়ানোর বায়না করার সেই অনুভূতিগুলো আজও উড়ে আসে পাখির মতো করে, রোদের উজ্জ্বল রক্ত ধুয়ে চুইয়ে পড়ে মেদুর অতীত। আমি শুধু তোমাকেই খুঁজি, তোমাকেই পেতে চাই, বাবা। তুমি কি জানো তোমার পুরনো ফাউন্টেনপেন দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিনই কিছু এলোমেলো শব্দ লিখি আর সাজাই কখনো বা ছড়িয়ে ফেলি? ছোটবেলায় তোমার কষ্টটা বুঝিনি বাবা। এখন খুব বুঝতে পারি তোমার রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভেজার কষ্ট। এখন বুঝতে পারি বাসায় মোটরসাইকেল রেখে তুমি কেন বাইসাইকেলে করে যাতায়াত করতে। বাবা, আমাকে বড় করতে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে, তাই না?
ছোটবেলায় খেলার ছলে যখন সন্ধ্যা গড়িয়ে এলেও বাসায় ফিরতাম না, তুমি খুঁজতে বেরিয়ে পড়তে আমাকে। আমি বাসায় না ফেরা পর্যন্ত একা বসে থাকতে খাবার টেবিলে, কখন মানিকটা আসবে তোমার, আর তুমি খাইয়ে দিবে স্বস্নেহে নিজের হাতে। আমাকে খাইয়ে দিয়ে তুমি নিজে কখনও খেয়েছিলে কিনা তা জানা হয়নি কখনও। কিন্তু আজ খুব ইচ্ছে করে জানতে। তুমি কি সেদিন সত্যিই খেয়েছিলে, বাবা? মাঝেমধ্যে দুপুর থেকে বসে থাকতে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে ধূসর কালো যামিনীর চাদরে ছেয়ে যেতো প্রকৃতি। তবুও রাতভর তুমি অপেক্ষা করতে আমার জন্য। অনেক সময় আমি বোকাও বাসায় ফিরতাম খুব দেরি করে। তখন যে তোমার অপেক্ষার সেই মানেটা বুঝতাম না, বাবা। বিরক্ত হয়ে পড়তাম তোমার প্রতি। কিন্তু এখন খুব বুঝি। এখন ইচ্ছে করে সারাদিন তোমার পাশে বসে থাকি, গল্প করি। কারণ তুমিই যে আমার জীবনের প্রথম বন্ধু, বাবা। তুমিই যে জীবন আমার।
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলায় মা ছিল না, আমি ভাত না খেলেও জোর করে খাইয়ে দিতে। আমি বলতাম- আব্বু পেট ভরা। আর খেলে পেট ফুটে যাবে বেলুনের মতো। কিন্তু তারপরও জোর করে খাইয়ে দিতে তুমি। কখনও জলপরীর গল্প বলতে, লিলিপুটের গল্প শুনাতে, ফলস্টাফের কাহিনী বলতে। সেই সময়গুলো হৃদয় আকাশে এখনও চাউর হয়ে আছে, বাবা। জলপরী ও কাঠুরিয়ার গল্প শুনিয়ে বলতে, কাঠুরের মতো সৎ মানুষ হতে হবে জীবনে। কবিতার ছলে বলতে, ‘সবার সুখে হাসবো আমি/কাঁদব সবার দুঃখে/নিজের খাবার বিলিয়ে দেব/অনাহারীর মুখে।‘ তোমার এই ছেলেটা তোমার সব উপদেশ মেনে চলবে বাবা।
মনে আছে বাবা, ছোটবেলায় আমি একবার বলেছিলাম রাতে জোছনা দেখব। তুমি তোমার ছোট্ট এই মানিকটাকে কোলে নিয়ে রাতভর জোছনা বিলাস করিয়েছিলে। চাঁদ মামা, চাঁদের বুড়ি- কত গল্প শুনিয়েছিলে। আমাকে কোলে নিয়ে বলতে, ‘আয় আয় চাঁদ মামা/টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ/টিপ দিয়ে যা।‘ জানো বাবা- এখনও আমার ইচ্ছে করে সেই গল্প শুনতে। এখনও সোনালী চাঁদ উঠে আকাশে কিন্তু চাঁদের জোছনায় সেই মমতার ছোঁয়া আর নেই।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় খুব জ্বরে পড়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিল খুব কঠিন জ্বর হয়েছে। আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে তুমি নিঃশেষ করে দিয়েছিলে চোখের জল। কিন্তু তোমার জন্য যখন আমি কাঁদতাম, তুমি বলতে- আমার চোখের জলের এক ফোটা নাকি মুক্তার দানার চেয়েও মহামূল্যবান। আমি জানি তুমি এমনই। খুব ভালোবাসো আমাকে। আমি যে কতটা ভালোবাসি তোমাকে তা যে কলমের কালিতে লিখে শেষ করা যাবে না, বাবা। আম আমার খুব প্রিয় বলে গাছের একটা আমও মুখে তুলতে না তুমি। দাদীর কাছ থেকে শুনেছি- আম তোমারও ভীষণ পছন্দ। শুধুমাত্র আমার পছন্দের জন্য নিজের পছন্দ বিসর্জন দিয়েছিলে তুমি। এভাবে কি কেউ কাউকে কখনো ভালোবেসেছে বাবা?
চিন্তা করো না বাবা। অবসান ঘটতে চলেছে তোমার কষ্টের দিনগুলোর। কষ্ট করে আর কাজ করতে দেব না তোমাকে। আমার জন্য আর মানুষের কাছ থেকে টাকাও ধার চাইতে হবে না। আর যারা তোমার কাছে টাকা পাবে তাদের সব টাকা আমি এবার ঘুণাক্ষরে শোধ করে দেব। আমাদের কাঁচা বাড়িটাও এবার পাকা করব। তোমার দোয়ায় একটা ভালো চাকরি পেয়েছি বাবা।
বাবা, রাতভর আর কাজ করতে দেব না তোমাকে। জর্জ হার্বার্ট বলেছিলেন, একজন পিতা একশ জন স্কুলশিক্ষকের চেয়ে উত্তম। সত্যিই বাবা তুমিই তো আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষক, আমার খেলার সাথী। তুমি আমার বন্ধু, আমার সুপারহিরো বাবা। তুমি ভালো থাকলেই ভালো থাকি আমি। আর হ্যাঁ, তোমাকে বিশ্ব বাবা দিবসের শুভেচ্ছা। ভালো থেকো বাবা। নিজের খেয়াল রেখো।
ইতি,
তোমার আদরের,
ফাহাদ হোসেন ফাহিম
লেখক: শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, পশুপালন অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২
এনএম

