রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ, বাতিল করতে হবে’

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৩, ১২:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ, বাতিল করতে হবে’

মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব ও প্রভাবশালীদের অপব্যবহারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’। ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর পাশ হওয়া বহুল আলোচিত এই আইনটি সাধারণ মানুষ ছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সাংবাদিকতার টুটি চেপে ধরেছে। এ আইনের কয়েকটি ধারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। আইনজ্ঞ, ভুক্তভোগী এবং সাংবাদিক নেতাদের দাবি, এই আইন বাতিল করা হোক। কেউ কেউ আবার বাতিল নয় সংশোধনের পক্ষে।

দুটি যুক্তিতে এ আইনের কতিপয় ধারা চ্যালেঞ্চ করে রিট করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব। দ্বিতীয়ত আদালতের প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করতে হয়। কিন্তু এসব ধারায় সুস্পষ্টভাবে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। পরে এসব ধারার অপব্যবহারের মাধ্যমে পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করার সুযোগ রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী এ আইনে ২০১৮ সালে ৩৪টি, ২০১৯ সালে ৬৩টি, ২০২০ সালে ১৯৭টি ও ২০২১ সালে ২৩৮টি মামলা হয়েছে বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৬১১ টি মামলা হয়েছে গত চার বছরে। বিভিন্ন মামলায় গত তিন বছরেই ৫৩ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। এজন্য আইনটি বাতিল চেয়েছেন আইনজ্ঞরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাউয়ুম ঢাকা মেইলকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুরোটাই বাতিল চাই। সংশোধন আমরা চাই না। কারণ সংশোধনের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এর আগে আইসিটি অ্যাক্টে ৫৭ ধারা সংশোধন করা হয়েছে। এই রকম সংশোধনের দরকার নেই। সংশোধনের মাধ্যমে মানুষের চোখকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইনটি জনবান্ধব হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। এটি সংশোধণ যোগ্য না। এই আইনের অধীনে ভুক্তভোগীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে ভয়াবহ। এটি সাধারণ আইন না। এ আইন বাতিল করতে হবে।

ঢাকায় কর্মরত পেশাদার রিপোর্টারদের বৃহৎ সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী ঢাকা মেইলকে বলেন, যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়, তখনই আমরা এটি চাইনি। আমরা বলেছিলাম যে এটি স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যাবে। এখন বাস্তবে তাই হচ্ছে। এটা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে। এই আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী মহল মামলা দিচ্ছে। এটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। এই অইন যেহেতু স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি তাই এই আইন আমরা চাই না।

তবে বাতিল নয়, এ আইনের সংশোধনী চান ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ডিজিটটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েটি ধারা সাংবাদিকদের হুমকি স্বরুপ। আমরা্ এটি বাতিল চাই না। সংশোধন চাই। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবী নির্বতনমলক ধারাগুলো সংশোধন করা হোক। এর আগে এটি নিয়ে বার বার সংশোধনের দাবী জানিয়ে এসেছি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেই দাবী মেনে নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি সাংবাদিক সংগঠনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে জোড়ালো দাবী তোলা হচ্ছে আইনটি বাতিলের। তখন আইনমন্ত্রী কয়েকটি ধারা সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছেন। আমাদের দাবী হচ্ছে এই আইনের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষ সংগঠনগুলোর সঙ্গে তথ্যমন্ত্রীর মতবিনিময় করা উচিত। নির্বতনমূলক ধারাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত। সাংবাদিক নেতারা এখনো জানেন না কোন কোন ধারাগুলো সংশোধন করা হবে। কাজেই এ বিষয়ে  পরিস্কার ধারণা দিতে হবে আইন মন্ত্রণালয়ের। কোন কোন ধারাগুলো তারা সংশোধন করতে চান, সেগুলো নিয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা হোক।


বিজ্ঞাপন


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করা হয়েছে। ধারাগুলো হলো ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ  ৯ জন ব্যক্তি এটি দায়ের করেন। আবেদনকারীরা হলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো: আসাদ উদ্দিন, মো: আসাদুজ্জামান, মো. জোবাইদুর রহমান, মো. মহিউদ্দিন মোল্লা ও মো. মুজাহিদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল, ড. মো. কামরুজ্জামান এবং ড. মো. রফিকুল ইসলাম।

রিটে তারা দুটি যুক্তি তুলে ধরেছেন। প্রথমত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’কে খর্ব করেছে। দ্বিতীয়ত আদালতের প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করতে হয়। কিন্তু এসব ধারায় সুস্পষ্টভাবে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। পরে এসব ধারার অপব্যবহারের মাধ্যমে পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয় ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর।

দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এরপর আইনটি কার্যকর করার পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে।

এ আইনে বলা হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোন তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে।

আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

এআইএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর