বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

মামলাজট নিরসনে অভূতপূর্ব সাড়া

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

মামলাজট নিরসনে অভূতপূর্ব সাড়া

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মামলাজট। এ যেন এক অস্বস্তি, নিঃশ্বাস ফেলারও উপায় নেই! তুচ্ছ কিংবা কম গুরুত্বপূর্ণ ও আপসযোগ্য মামলার কারণেই এই জট বাড়ছে। এতে আপস ও মীমাংসাযোগ্য অনেক ছোটখাটো মামলাও বিচারাধীন থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

তবে ইতোমধ্যেই বিচারপ্রার্থীদের এই ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে এবং মামলাজট নিরসনে মনিটরিং সেল গঠন করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এতে অভূতপূর্ব সাড়াও মিলেছে। সেই সঙ্গে দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ায় সময়ের সাথে কমে আসছে মামলাজট।


বিজ্ঞাপন


সুপ্রিম কোর্টের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) থেকে গত ৩০ জনু পর্যন্ত (ছয় মাস) ঢাকা বিভাগের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মিলিয়ে মোট দুই লাখ ৬১ হাজার ৬২৬ মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৬০৮টি। পাশাপাশি চট্টগ্রামে এক লাখ ৩২ হাজার ৫০৮ মামলার মধ্যে এক লাখ ২৯ হাজার ৯২৬টি, রাজশাহীর ৮৩ হাজার ১৮৫টির মধ্যে ৭৩ হাজার ৬৮৩টি এবং খুলনার ৮৪ হাজার ৭৫৯টির মামলার মধ্যে ৭৪ হাজার ৬৯৪টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

courtএছাড়া একই সময়ে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মিলিয়ে রংপুর বিভাগের ৫৩ হাজার ৬৭৩টি মামলার মধ্যে ৫২ হাজার ৮৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। পাশাপাশি বরিশালের ৪৪ হাজার ৬৫৬টি মামলার মধ্যে ৪০ হাজার ৯১১টি, সিলেটের ৩৯ হাজার ১৯৭টির মধ্যে ৩৭ হাজার ৪৭৩টি, ময়মনসিংহের ৪৭ হাজার ৯০৪টি মামলার মধ্যে ৫১ হাজার ৮১১টি।

এর আগে সারাদেশের মামলাসমূহ মনিটরিংয়ের জন্য আট বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর ছয় মাসের মাথায় সফলতা আসে মামলা নিরসনে। তবে বিচারিক আদালতের মামলার তদারকি সুপ্রিম কোর্ট সেলের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এটি ধরে রাখলে মামলাজট খুব দ্রুতই কমবে বলেও মনে করছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা।

সুপ্রিম কোর্টের হিসাবমতে, দেশের সব অধস্তন আদালতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে আট লাখ ৫৯ হাজার ৩২৬টি মামলা। এরমধ্যে ফৌজদারি মামলা তিন লাখ ৫১ হাজার ৫৪৮টি। আর দেওয়ানি মামলার সংখ্যা পাঁচ লাখ সাত হাজার ৭৭৮টি। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের মামলার তালিকা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ওইসময় দেশে বিচারাধীন ছিল ৪০ লাখ ২১ হাজার ৭৬৩টি মামলা, যার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৬ হাজার ৮৫১ এবং হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ লাখ ২২ হাজার। আর ৬৪ জেলার আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৯১৩টি।

এদিকে, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে সারাদেশের আদালতে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ঢাকা বিভাগে, এক লাখ ২৫ হাজার ৪৫৬টি। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৪ হাজার ৯৪১, রাজশাহী বিভাগে ৭১ হাজার ৫৭৯, খুলনা বিভাগে ৮৫ হাজার ৮৭০, বরিশাল বিভাগে ৪২ হাজার ৬৭০, সিলেট বিভাগে ২১ হাজার ৬৩১, রংপুর বিভাগে ১৯ হাজার ৯৮৪ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে রয়েছে ৬৫ হাজার ৬৫৭টি মামলা।

অন্যদিকে, বিগত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে সারাদেশের আদালতে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার মধ্যেও ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি রয়েছে, এক লাখ ৩৭ হাজার ৫৫২টি। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১ হাজার ৬০, রাজশাহী বিভাগে ৪৫ হাজার ২৬৯, খুলনা বিভাগে ২৯ হাজার ৮৮৭, বরিশাল বিভাগে নয় হাজার ৯৯২, সিলেট বিভাগে ১৩ হাজার ৪৯৭, রংপুর বিভাগে ৩৪ হাজার ৯৩৫ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে রয়েছে নয় হাজার ৩৫৬টি মামলা।

এসবের মাঝে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ জানুয়ারি আট বিভাগের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের আটজন বিচারপতির নেতৃত্বে আটটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। এমনকি মনিটরিং কমিটি গঠনের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতিরা বিভিন্ন আদালতও পরিদর্শন করেছেন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলার বিচারকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, তাঁদের সমস্যার কথা শুনেছেন।

Caseযদিও ২০০০ সালের আগ থেকেই বিচারাধীন মামলার তালিকা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এতে দেখা যায়, ২২ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে পাঁচ হাজারের বেশি মামলা, যা চলতি বছরের ডিসেম্বরের আগেই নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

মামলাজট নিরসনের লক্ষ্যে পাঁচ বছরের অধিক পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে ২০১৮ সালে সারাদেশের নিম্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছিল।

ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশা। ফলে মামলা নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধিসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঁচ বছরের অধিক পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি করে ক্রমবর্ধমান মামলাজট নিরসনের বিকল্প নেই।

বর্তমান সময়ে এসে সুপ্রিম কোর্টের ছয় মাসের তথ্যেই মামলাজট নিরসনে সফলতার ঝলক দেখা গেছে। এতে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য- এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি যেমন দূর হবে তেমনি মামলাজট খুব দ্রুতই কমে আসবে।

এ ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, বিচারিক আদালতের মামলা তদারকিতে মনিটরিং সেল গঠন মাননীয় প্রধান বিচারপতির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বিগত ছয় মাসের মনিটরিংয়ে মামলা নিষ্পত্তিতে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। এটিকে ধরে রাখা গেলে বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি দূর হবে। মামলাজট কমবে বলে আশা করি।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, বিচারিক আদালতের মামলা তত্ত্বাবধান করা সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এ কথা সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে। এ জন্য প্রধান বিচারপতি সারাদেশের বিচারিক আদালতের মামলাগুলো কেয়ারটেকার করতে মনিটরিং সেল গঠন করে দিয়েছেন। পূর্বেও দেখেছি- সুপ্রিম কোর্ট যখন অবকাশকালীন ছুটি থাকত, তখন বিচারপতিরা মামলার মনিটরিং করার জন্য নিম্ন আদালতে যেতেন।

মনজিল মোরসেদ বলেন, এই মনিটরিং কমিটি সারাবছর নিয়মিতভাবে কাজ করলে বিচার বিভাগের জন্য শুভ হবে। তবে মামলাজট কমাতে সরকারকে নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। আদালতের অবকাঠামো বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে বিচারক নিয়োগ। সিস্টেমের উন্নতি করতে হবে।

বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রধান বিচারপতির এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। মনিটরিং সেল নিয়মিতভাবে মামলার বিষয়ে মনিটরিং করলে মামলাজট কমবে। রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় রোধ হবে। বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার পাবে। ভোগান্তি দূর হবে। এমন উদ্যোগ আরও বহু আগে নিলে বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের ভোগান্তি কমতো।

এই আইনজীবী আরও বলেন, আদালতসমূহে ছোটখাটো অনেক মামলা বিচারাধীন আছে। বছরের পর বছর এগুলো ঝুলছে। যেসব অপরাধের সাজা খুবই অল্প সময়ের জন্য যেসব মামলা তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করা উচিত। এমনও মামলা আছে, যার অপরাধ প্রমাণ হলে সাজা হবে ছয় মাসের। কিন্তু এগুলো বিচারের জন্য ঝুলে আছে বছরের পর বছর। নিয়মিত মনিটরিং করলে এবং ছোটখাটো মামলাগুলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে।

এআইএম/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর