শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বিনাদোষে কারাভোগ: ক্ষতিপূরণের আইন আছে, প্রয়োগ নেই

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ৩০ জুলাই ২০২২, ০৬:২২ পিএম

শেয়ার করুন:

বিনাদোষে কারাভোগ: ক্ষতিপূরণের আইন আছে, প্রয়োগ নেই
ইনসেটে বিনা দোষে কারাভোগ করা জাহিদ শেখ (ফাইল ছবি)

৪৮ বছর বয়সী জাহিদ শেখ, বাড়ি খুলনায়। স্ত্রী ও সন্তান হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে ২০ বছর ছিলেন কনডেম সেলে। অবশেষে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পেয়েছেন তিনি। মুক্তির পর কারাগার থেকে বেরিয়ে জানিয়েছেন কনডেম সেলের দুর্বিষহ জীবনের কথা। যেকোনো সময় ফাঁসির মঞ্চে যেতে হবে-এমন আতঙ্কের মধ্যে তাকে কাটাতে হয়েছে ২০ বছর।

বিনাদোষে জেলে থাকা জাহিদের মতো এরকম অসংখ্য ভুক্তভোগী রয়েছেন। তাদের প্রতিকারের কথা আইনে বলা থাকলেও এর কোনো প্রয়োগ নেই। কারণ এর ক্ষতিপূরণ বা প্রতিকার পেতে পোড়াতে হয় অনেক কাঠখড়। এমনিতেই বছরের পর বছর মামলা চালাতে শেষ হয়ে যায় জমানো অর্থকড়ি। তারপরে আবার নিজের প্রতিকার চেয়ে আদালতে মামলা করার সাহস হারিয়ে ফেলেন অনেকেই। কেউ কেউ অতিরিক্ত ঝামেলা মনে করে সামনের দিকে এগোতে অনীহা দেখান।

দীর্ঘ দিন কনডেম সেলে থাকা জাহিদ শেখ অনেকের ফাঁসি কার্যকর হতে দেখেছেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কখনও ভাবিনি ছাড়া পাবো। আমি নির্দোষ ছিলাম। কারাগারে ২০ বছর অনেক কষ্টে কেটেছে। আমার এখন কেউ নেই, কিছু নেই। জেলে থাকা অবস্থায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। নিজের বাড়ির সম্পত্তি বলতে যা ছিল, মামলার খরচ চালাতেই চলে গেছে।’

২০০০ সালের ২৫ জুন বাগেরহাটের আদালত রায়ে এ মামলার একমাত্র আসামি খুলনার জাহিদ শেখকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেন। রায় ঘোষণার আগে জাহিদ আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বিচারিক আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। চার বছর পর হাইকোর্টে শুনানি হয়। এরপর ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই সেখানেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে কারাগার থেকে ২০০৭ সালে আপিল বিভাগে জেল আপিল করেন জাহিদ। এই দীর্ঘ সময় মামলাটি ওই বিভাগেই পড়ে ছিল। পরে মামলাটি নজরে আসে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের।

মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন সর্বোচ্চ আদালত। নিযুক্ত করা হয় জাহিদের আইনজীবীকে। কিন্তু মামলার শুনানি করতে গিয়ে আপিল বিভাগ দেখেন নানা অসঙ্গতি রয়েছে। বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরলে দীর্ঘ শুনানি শেষে গত বছরের ২৫ আগস্ট আপিল বিভাগ জাহিদকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। বিনা দোষে ২০ বছর কারাভোগ করে অবশেষে মুক্তি পান জাহিদ।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: কনডেম সেলেই বছরের পর বছর

সম্প্রতি এমন বেশ কিছু পুরনো মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বিচার শেষে আপিল বিভাগ খালাস দিয়েছেন। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক নিরপরাধ আসামি বছরের পর বছর কারাগারের কনডেম সেলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এদিকে তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি রিট দায়ের করেছেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কারাবন্দি ও কনডেম সেলের সংখ্যা, কারাগারের সংস্কার, ব্যবস্থাপনা, কনডেম সেলের সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত প্রতিবেদন চেয়েছেন।

বিনাদোষে কারাভোগের প্রতিকার নিয়ে যা বলছেন আইনজীবীরা

বিনাদোষে কারাভোগ করা ব্যক্তিদের প্রতিকার নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পায় দুইভাবে। প্রথমটা হচ্ছে, যে সমস্ত মামলা হয়রানি বা মিথ্যাভাবে দায়ের করা হয় সেগুলো প্রমাণ করা যায় না। এসব মামলা থেকে তারা খালাস পায়। কিছু মামলা আছে সাক্ষী বা অন্যান্য নথি দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করা যায় না। এজন্য ফৌজদারি আইন অনুযায়ী আসামি খালাস পায় (বেনিফিট অপ ডাউট), অপরাধ হলেও প্রমাণ না হওয়ায় খালাস পায় আসামি। তবে কেউ কাউকে হয়রানি করার জন্য মামলা করলে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। এসব বিষয়ে দুইভাবে প্রতিকার পাওয়া যায়, সিভিল ও ক্রিমিনাল মামলা দায়ের করে।

এই আইনজীবী বলেন, অনেক সময় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও মামলা হয় এবং আসামির জেল দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। কারণ এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব আছে। এসব হয়রানি থেকে মুক্তির জন্য একটি ফান্ড থাকা দরকার।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মামলায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারবে। বাদীর বিরুদ্ধে মামলার বাদীর ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে মামলা করতে পারবে। বিশেষ আইন ও প্রচলিত আইনে এই ব্যবস্থা আছে। যদি কেউ বিনা দোষে বছরের পর বছর কারান্তরীণ থাকে, তাহলে তিনি চাইলে ওই ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারবেন। 

আরও পড়ুন: যেসব মৌলিক অধিকার দিয়েছে সংবিধান

কিন্তু সচরাচর এরকম মামলা কেউ করে না। ভুক্তভোগী চিন্তা করে যে, মামলায় খালাস পেয়েছে এটাই যথেষ্ট। নতুন করে কোর্ট-কাচারিতে আর ঘুরতে চায় না। ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

এই আইনজীবী আরও বলেন, আমার উকালতি জীবনে এরকম দেখিনি যে, কেউ মিথ্যা মামলায় খালাস পেয়ে বাদীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আমি অনেক পার্টিকে বলছি মামলা করতে, কিন্তু সে আর আগ্রহ দেখায়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ফারুক হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আদালত নিজের ইচ্ছায় অথবা ভুক্তভোগীর আইনগত বিধান আছে। রাষ্ট্রেরও এখানে দায়ভার এড়াতে পারে না। রাষ্ট্র তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে দেয়, কোর্টে জোরালো ভূমিকা পালন করে। এসব মামলায় তদন্তের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সংস্থাগুলো গুরুত্ব কম দেয়। সেই দিকে রাষ্ট্র এসব ঘটনায় দায়ভার এড়াতে পারবে। কেননা ফৌজদারি মামলা রাষ্ট্রের একটি বড় ভূমিকা রাখে। যেকোনো ভুক্তেভোগী ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারে, এটা তার আইনগত অধিকার।

এআইএম/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর