গত বছরের ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগে একটি পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এর অংশ হিসেবে বিচারক নিয়োগের বিষয়টি রাজনৈতিক প্রভাব ও সুপারিশমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় নির্ধারিত আইনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বেশ কিছুসংখ্যক ‘অতিরিক্ত বিচারক’ নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারক পাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিচারপতি নিয়োগে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত খসড়া চূড়ান্ত করেছে। ৫৯ জন প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছে কাউন্সিল। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি সেটি অনুমোদন করলে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে আইন মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞাপন
- নিয়োগ পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি বাদ
- সরাসরি ভাইভা নিচ্ছেন প্রধান বিচারপতি
- বিচারক নিয়োগে নতুন দিগন্তের সূচনা
- সৎ ও যোগ্যদের অগ্রাধিকার পাওয়ার সুযোগ
- নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈষম্যের অভিযোগ কারও কারও
অতীতে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ ছিল রাজনৈতিক প্রভাব ও সুপারিশনির্ভর। এনিয়ে নানা আলোচনা ও বিতর্কের শেষ ছিল না। বিচারক নিয়োগ হলেও এতদিন ছিল না সুনির্দিষ্ট কোনো আইন। দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বিচারক নিয়োগে একটি সুনির্দিষ্ট আইনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সংবিধানে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ থাকলেও তা রাজনৈতিক কারণে করা হয়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কর্মসূচির আওতায় জানুয়ারিতে এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠন করে।
এ কারণে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিচারক নিয়োগ হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে। সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা যেন এই পদে আসতে পারেন সে কারণেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেমন বিচারক নিয়োগের প্রত্যাশা করেন এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই মেধাবী, সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের নিয়োগ দিতে হবে।’
বিজ্ঞাপন
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ও বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রশ্নাতীত সততা আর দু’কলম লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে এই পদে নিয়োগ দিতে হবে।’
জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর হাইকোর্ট বিভাগে একদফা বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগকৃতদের কয়েকজনকে নিয়ে অনেকের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। আমারও আছে। যেটি আমি মাননীয় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে জানিয়েছি। তিনিও জনসম্মুখে বলেছেন, জরুরি ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ দিতে গিয়ে তারা প্রত্যেক বিচারপতির সবকিছু যাচাই বাছাই করতে পারেননি। এজন্য নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছেন। আসন্ন নিয়োগ এই অধ্যাদেশের আলোকে হবে বলে সহজেই অনুমেয়।’
রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘ভবিষ্যৎ নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদার সাথে যায় এমন ব্যক্তিদের বিচারপতি নিয়োগ দিতে গত মাসে কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীর উপস্থিতিতে মাননীয় প্রধান বিচারপতির প্রতি আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম। ব্যক্তির সততা যেন প্রশ্নাতীত হয় সেটার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছি, এমন ব্যক্তিকে যেন নিয়োগ দেওয়া হয় যিনি দু’কলম লিখতে পারেন।’
বিএনপিপন্থী এই আইনজীবী বলেন, ‘প্রশ্নাতীত সততা আর দু’ কলম লেখার যোগ্যতাটা আমার কাছে উচ্চ আদালতে বিচারপতি হওয়ার মাপকাঠি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কেন এই দুটি যোগ্যতার ওপর জোর দিচ্ছি? সহজ উত্তর, বিচারপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদালতে গিয়ে তাঁকে ‘মাই লর্ড’ বলে সম্ভাষণ করতে হবে। আমি তাকেই ‘লর্ড’ এর জায়গায় দেখতে চাই, যিনি ‘লর্ড’ হওয়ার যোগ্য। এছাড়া ক্রমেই আমাদের এই আইন পেশাটা মেধাহীন হয়ে পড়ছে। যেসব লোকের বিচারপতি হওয়ার কথা শুনি তারা নিয়োগ পেলে তো এই পেশা ছেড়ে পালাতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন এই বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বিচারক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর প্রায় তিনশটি আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকে বাছাই করে গত শুক্রবার ৫৯ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চূড়ান্তভাবে কতজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে সেটি কাউন্সিলের বিষয়।
পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, কাউন্সিল চূড়ান্ত তালিকা করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। অনুমোদনের পর গেজেট প্রকাশ করবে মন্ত্রণালয়।
এদিকে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. পারভেজ হোসেনসহ তিনজন আইনজীবী। নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ না করলে তারা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। পারভেজ হোসেন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেটদের মধ্যে সিভি জমা দিয়েছিলেন ৩০০ মতো। তার মধ্যে ডেকেছে ৫৩ জনকে। সারাদেশের জেলা জজদের মধ্য থেকে ১৩ জনকে ডাকা হয়েছে। এটাকে আমরা বলব বড় ধরনের বৈষম্য। এদের মধ্যে থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদের ডাকা হয়েছে, যারা পাস কোর্স করেছেন তাদের ডাকা হয়নি। কোনো প্রকার গাইড লাইন ছাড়াই এটা করা হচ্ছে। লিগ্যাল নোটিশের জবাব না দিলে আমরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সংক্রান্ত কমিশন বেশ কিছু সুপারিশও করেছে সরকারের কাছে। প্রস্তাবিত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠন, দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন, জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত এবং উপজেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা। এছাড়া স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের বিষয়েও সুপারিশ করা হয়।
২১ জানুয়ারি ‘সুপ্রিম কোর্র্টে বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এর আলোকে প্রধান বিচারপতিকে চেয়ারপারসন করে সাতজনকে নিয়ে গঠিত হয় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল।’এরপর ২৮ মে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এরপর আবেদনকারীদের মধ্য থেকে ৫৯ জনকে বাছাই করে কাউন্সিল। পরবর্তীতে যাদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়।
সর্বশেষ গত বছরের ৮ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে ২৩ জনকে নিয়োগ দেয় সরকার। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপনে নতুন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে জানানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এসব অতিরিক্ত বিচারকের মেয়াদ হবে শপথ নেওয়ার দিন থেকে দুই বছর।
রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৮ নম্বর অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এই নিয়োগ দেন। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে ৯০ জন বিচারপতি রয়েছেন এবং ৫ লাখ ৯৯ হাজার ১২৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর আপিল বিভাগে ৩৪ হাজার ৯৮১টি মামলা বিচারাধীন, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি।
এআইএম/জেবি

