শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আদালতের আগে যেতে হবে লিগ্যালএইডে, ৯ আইনের সংশোধনী ঘিরে বিতর্ক

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ০৪ জুলাই ২০২৫, ০২:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

আদালতের আগে যেতে হবে লিগ্যালএইডে, ৯ আইনের সংশোধনী নিয়ে ‘বিতর্ক’

দেশের আদালতগুলোতে এমনিতেই বছরের পর বছর মামলার চাপ বাড়ছে। ভোগান্তির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিচার প্রার্থীদের। এ অবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের কথা বলে সম্প্রতি নয়টি আইনে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এনেছে আইন মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের মামলা নিষ্পত্তির আগে লিগ্যালএইডের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা চালু করা হয়েছে।

তবে নতুন এই সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।


বিজ্ঞাপন


যে নয়টি আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে সেগুলো হলো-

১. পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩

২. বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১

৩. সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন সম্পর্কিত বিরোধ


বিজ্ঞাপন


৪. State Acquisition and Tenancy Act, 1950 - ধারা ৯৬: অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ

৫. Non-Agricultural Tenancy Act, 1949 - ধারা ২৪

6. পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ - ধারা ৮

৭. নেগোশিয়েবল ইন্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১ - ধারা ১৩৮ (৫ লাখ টাকার কম চেক ডিজঅনার)

৮. যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ - ধারা ৩ ও ৪

৯. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ - ধারা ১১(গ)

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ার হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, এসব সংশোধনী বাস্তবায়ন অসম্ভব। অকল্পনীয়। ঢাকা বারে দীর্ঘ্যদিন ধরে প্র্যাকটিস করা এই আইনজীবী আরও বলেন, শুধুমাত্র ঢাকার পারিবারিক মামলা নিষ্পত্তি করতেই আদালত আছে পাঁচটি। এই পাঁচটি আদালতেই হাজার হাজার মামলা। এগুলো লিগ্যালএইডের অফিসে গেলে ভোগান্তি বাড়বে চরম আকারে। কারণ এতো বিচারপ্রার্থীর আবেদন লিগ্যাল এইড অফিস সামলাবে কিভাবে? সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বিচার প্রার্থীদের কল্যান বয়ে আনবে না।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব ঢাকা মেইলকে বলেন, লিগ্যাল এইড মূলত গরিব ও অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেয়। সেখানে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার মাধ্যমে কোটিপতিরাও এই সুযোগ নেবেন—এটা মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। সেই আর্থিক অনুদানের ভাগ একজন কোটিপতি বা সচ্ছল ব্যাক্তি পেতে পারেন না। এতে ফান্ড অপচয় হবে এবং ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে।

“সরকার ৯টি আইনের সংশোধন করে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য লিগ্যালএইড অফিসকে যে দায়িত্ব দিয়েছে। সেটা মূলত লিগ্যাল এইডের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চেকের মামলা, যৌতুক নিরোধ আইনের দুটি ধারা, অগ্রক্রয়সহ যেসব আইন সংশোধন করে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে মধ্যস্থতার যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়াবে।”

তিনি আরও বলেন, এসব আইনের মামলায় কোর্টেও আপস-মীমাংসার বিধান ছিল। কিন্তু সেই বিধান যুক্ত করা হচ্ছে লিগ্যাল এইড অফিসের সঙ্গে। মানে লিগ্যাল অফিসকে আরও কাজ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনিতেই এই অফিসের লোকবল অনেক কম। নতুন করে মামলা মেটানোর দায় চাপালে আরও সমস্যার সম্মুখীন হবেন তারা। এতে করে বাড়বে বিচারপ্রার্থীদের অহসনীয় ভোগান্তি।

এই আইনজ্ঞ আরও বলেন, এসব আইনের মামলায় আদালত বাদী-বিবাদীকে কোর্টের বাইরে গিয়ে আপস মীমাংসা করার প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। বাদি বিবাদীরাও কোর্টের বাইরে বসেন। আপস না হলে কোর্টে এসে জানিয়ে দেন। কিন্তু তারা কখনই বাইরের সব কথা কোর্টকে অবহিত করেন না।

আর নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে কোর্টের বাইরের কথাও রেকর্ড করার সুযোগ হলো। তার মানে সরকারের করা ৯টি আইনের নতুন সংশোধনী বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি বাড়বে। কমাবে না। সময়ও নষ্ট হবে। লিগ্যাল এইডের ফান্ড অপচয় হবে। মিসইউজ হবে।

সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের সারা দেশে লিগ্যালএইডে ম্যান পাওয়ারের অভাব রয়েছে। কাজেই চাইলে এসব আইনরে মামলা সহজে নিষ্পত্তি করে দিতে পারবে না লিগ্যালএইড অফিস। সরকারের এই আইনের কারণে ভোগান্তি বাড়বে, কমবে না। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় চেকের মামলা বেশি বেশি দায়ের করা হয়। এতো মামলা সহজেই নিষ্পত্তি করা এইডের পক্ষে সম্ভব না।

শুধু তাই নয়, নারী শিশু আইনের ১১(গ)তে বলা হয়েছে নির্যাতনের ফলে জখম। এই জখমটা ফৌজদারি অপরাধ। একটি অপরাধ সংগঠিত হয়ে গেলে সেটি লিগ্যাল অফিসে বসে কীভাবে মীমাংসা করা সম্ভব। মামলা ছাড়া ফৌজদারি অপরাধ আপস হতে পারে না।

এই আইনটি বিশেষ করে ১১ (গ) অসাংবিধানিক। তিনি বলেন, দেওয়ানি কিছু মামলা আপস করা যেতে পারে। যেমন চেকের মামলা আপস করার জন্য বসা যেতে পারে। কিন্তু ফৌজদারি অপরাধ মামলার আগে কীভাবে আপস হবে?

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম লিমন ঢাকা মেইলকে বলেন, সংশোধিত এ আইনগুলো বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, এই আইনের তফসিলে বর্ণিত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে, সংক্ষুব্ধ পক্ষকে আবশ্যিকভাবে উক্ত বিরোধ প্রথমে লিগ্যালএইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আবেদন করিতে হইবে, এবং মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হইলে বিরোধের কোনো পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করিতে পারিবে।”

প্রশ্ন উঠেছে—এই বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা কি বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য আশীর্বাদ, নাকি আরেক দফা হয়রানি? প্রথমত, লিগ্যাল এইড অফিসে যাওয়া মানে এক নতুন প্রক্রিয়া শুরু হওয়া, যা মামলা শুরুর পূর্বে বাড়তি সময় ও জটিলতা সৃষ্টি করবে। এই প্রক্রিয়ায় মামলা গ্রহণের পূর্বে কাগজপত্র যাচাই, ডাকাডাকি, তারিখ নির্ধারণ, মধ্যস্থতার সময়সীমা—সব মিলিয়ে বিচারপ্রার্থীকে আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, লিগ্যালএইড অফিসের সুবিধা প্রাপ্তি ও কার্যকারিতা সারাদেশে এখনো সমভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। অনেক এলাকায় দক্ষ মধ্যস্থতাকারী, পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এর ফলে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন, বিশেষ করে যাদের মামলাটি তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তির প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, আর্থিক খরচের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও লিগ্যাল এইড মূলত বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়ার কথা, কিন্তু প্রক্রিয়ার দীর্ঘায়ন ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন, ট্রাভেল, সময় ব্যয় ইত্যাদি মিলে ব্যক্তিগত খরচ বেড়ে যায়। এমনকি অনেক সময় ক্লায়েন্টরা দ্বৈত খরচের মুখোমুখি হন—প্রথমে মধ্যস্থতা, পরে মামলার ব্যয়।

এই গেজেট অনুযায়ী চেক ডিজঅনার, ভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ, বণ্টন মামলা, যৌতুক নিরোধ কিংবা পিতামাতার ভরণপোষণের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না—এটি সাধারণ মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে।

এই আইনজীবী আরও বলেন, এই ধরনের বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা চালু করার আগে সিনিয়র আইনজীবী, বিচারপতি ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করাই ছিল সমীচীন। কারণ, আইনের উদ্দেশ্য যদি হয় ন্যায়বিচার সহজতর করা—তাহলে যে কোনো প্রক্রিয়া বিচারপ্রাপ্তির পথকে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল করলে তা মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাহিদা খানম ঢাকা মেইলকে বলেন, চেকের মামলার বিষয়ে আইনে যেটা সংশোধন হলো সেটি অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ। এটি পদ্ধতিগতভাবে করা হয়নি। ইচ্ছা করছে, আইনটা সংশোধন করে দিয়েছে। এতে করে মক্কেলের আরও ভোগান্তি বাড়বে। মামলাটা আরও জটিল হবে। এমন আইন করা উচিত না, যাতে করে মানুষের উপকার না হয়ে ক্ষতির কারণ হয়।

এর আগে গত ১ জুলাই এ আইনগুলো সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর গেজেট আকারে তা প্রকাশ করা হয়।

এআইএম/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর